ভাষা আন্দোলনের বয়স ৬৫ বছর পরেও বাংলা বানান নিয়ে চলছে ব্যাপক ধরনের নৈরাজ্য। পত্রপত্রিকা দেখলে বোঝা যায় বানানের ক্ষেত্রে আমরা কতটা উদাসীন।
বিশেষ করে মফস্বল থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলো আমাদের বেশি হতাশ করে। এসব সংবাদপত্রে ‘হ্রস্ব ই কার (ি ) ও দীর্ঘ ঈ কার ( ী)’ ব্যবহারে চলছে অরাজকতা। আবার একই সংবাদপত্রে দুই ধরনের বানান ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন কোথাও ‘সরকারি’, ‘সহযোগিতা’, ‘বাড়ি’ ‘শ্রেণি’ ‘প্রার্থিতা’ আবার কোথাও ‘সরকারী’, ‘সহযোগীতা’ ‘বাড়ী’ ‘শ্রেণী’ ‘প্রার্থীতা’ ইত্যাদি। কেউ লিখছেন ‘সূত্র’, ‘ব্যবসায়ী’, ‘সুষ্ঠু’; আবার কেউ লিখছেন ‘সুত্র’, ‘ব্যবসায়ি’, ‘সুষ্ঠ’। যারা সচেতন পাঠক তারা এসব বানান দেখে বিভ্রান্তিতে পড়ছেন। আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারা কার কাছে এর প্রতিকার চাইব?
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের বয়স ৬৫ বছর হচ্ছে এবার। এত বছর পরও রাষ্ট্র ও সমাজের ভাষা হতে পারেনি বাংলা। এখন দেশ স্বাধীন। বাংলা রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান ক্ষেত্রের ভাষা আজও বাংলা হয়নি। এটা কারও ব্যক্তিগত সমস্যা নয়। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের সমষ্টিগত সমস্যা। অনেক নিপীড়ন সহ্য করে বাংলা ভাষা টিকে আছে। ইংরেজি ও হিন্দির উৎপাত চলছে বাংলার ওপর। ভাষা আন্দোলনের মূল প্রত্যাশা ছিল সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের মধ্য দিয়ে বাংলায় শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা। ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন হয়েছে। আমাদের রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছে ভাষাভিত্তিক। অথচ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সর্বস্তরে সেই ভাষা চালু হয়নি। আমরা চেয়েছিলাম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আদালতসহ সবখানে বাংলা ভাষার প্রচলন হবে, কিন্তু তা হয়নি। এ রাষ্ট্রে মাতৃভাষার চর্চাই প্রধান হিসেবে গৃহীত হবে, জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন-গবেষণা হবে বাংলা ভাষায় এটাই ছিল স্বাভাবিক। ব্রিটিশ, পাকিস্তান আমলেও বাংলা ভাষার পক্ষে জনমত ছিল, অন্য ভাষার প্রভুত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে আজ সেই প্রতিবাদ নেই। সচেতনতা নেই, যা হওয়া অনিবার্য ছিল।
সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন করা এখনও আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষার সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার কিছু চ্যালেঞ্জও ছিল। সেজন্য বাংলায় বই লেখা এবং বিদেশী বই অনুবাদ করা দুটিরই দরকার ছিল। কাজগুলো বিগত বছরগুলোতে একটু এগিয়েছে, তবে তা উল্লেখযোগ্য নয়। উচ্চস্তরের অধিকাংশ বই ইংরেজিতে লেখা। এটাও সত্য, সাহিত্য, প্রবন্ধ ও বিভিন্ন বিষয়ের বই বাংলায় প্রচুর লেখা হয়েছে। তবে মৌলিক ও উচ্চশিক্ষার বই লেখার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা আছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের এতগুলো বছর পরও বিশ্বের বাংলাভাষীদের কাছে আমরা বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ তুলে ধরতে পারছি না। এ ব্যর্থতার দায়ভার আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর।
স্বাধীনতা লাভের পরও সমাজে কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। সমাজটা আগে যেমন শ্রেণীবিভক্ত ছিল, এখনও সেরকমই রয়ে গেছে। শ্রেণী বিভাজন সমাজ সংরক্ষিত হচ্ছে পুঁজিবাদের কারণে। সমাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিত্তবানরা। তারা ইংরেজিতে কথা বলেন। বাংলা বললেও তা হয় ইংরেজি মিশ্রিত। বাংলা ভাষা অনেক রক্তের বিনিময়ে মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বাংলার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হতে দেয়া যাবে না।
-সম্পাদক