Don't Miss
Home / জাতীয় / রাজধানী / যানজটের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া : গুরুতর রোগে আক্রান্ত ঢাকাবাসী

যানজটের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া : গুরুতর রোগে আক্রান্ত ঢাকাবাসী

এমএনএ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন : যানজটের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় গুরুতর রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন ঢাকা মহানগরবাসী। যানজট ঢাকার মানুষদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিচ্ছে। বিভিন্ন পরিবহনে দীর্ঘ সময় একটানা বসে থাকতে থাকতে মানুষের মেরুদণ্ডের সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে। এভাবেই এখন ঢাকায় জনে জনে দেখা দিচ্ছে নানা শারীরিক ও মানসিক সমস্যা। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে মেরুদণ্ড, শ্বাসতন্ত্র, স্নায়ু ও মস্তিষ্ক, কান ও মানসিক চাপজনিত অসুখ। পরিস্থিতি এতোটাই ভয়াবহ যে এ নিয়ে যতটা দ্রুত সম্ভব গবেষণা চালিয়ে সমস্যা সমাধানে সাধারণের জন্য বিকল্প দিক-নির্দেশনা দেয়া। যাতে যানজটের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় গুরুতর রোগে আক্রান্ত হওয়া থেকে রেহাই পেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভালুয়েশনের প্রতিবেদন অনুসারে এত দিন বায়ুদূষণে সবার ওপরে ছিল চীনের বেইজিং। গত দুই বছরে বেইজিংকে টপকে ওই স্থান দখল করেছে ভারতের দিল্লি। এর পরেই শীর্ষ ১০ দূষিত বায়ুর শহরের মধ্যে এবার দ্বিতীয় স্থানে এসেছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা।
আবার পরিবেশ অধিদপ্তরের সর্বশেষ এক প্রতিবেদনে ঢাকায় শীতের সময় (নভেম্বর-মার্চ) বায়ুদূষণের মাত্রা (পিএম-২.৫-এর নিরিখে) প্রায় পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। এ সময় বাতাসে সবচেয়ে ক্ষতিকর সূক্ষ্ম বস্তুকণা (পার্টিক্যাল ম্যাটার-২.৫ বা পিএম ২.৫) অস্বাভাবিক মাত্রায় থাকে। অপেক্ষাকৃত স্থূল বস্তুকণা পিএম-১০-এর মাত্রাও অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি থাকে।
বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা জানান, বাতাসে নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, হিলিয়াম, নিয়ন, আর্গন, সিসা, তামা, ক্যাডমিয়াম, নিকেল, ধূলিকণা থাকে। প্রতিটি উপাদানের একটি সহনীয় মাত্রা রয়েছে। কোনো উপাদান ওই মাত্রার বেশি বা ক্ষেত্রবিশেষে কম হলে তা বায়ুদূষণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর ঢাকায় যেখানে যানজট সেখানে বিভিন্ন পরিবহনের যাত্রীদের পড়তেই হয় এই দূষণচক্রের কবলে।
বাংলাদেশ হার্ট অ্যান্ড চেস্ট সোসাইটির মহাসচিব ডা. আবু রায়হান বলেন, ধোঁয়া ও ধুলাজনিত দূষণের ফলে শ্বাসকষ্ট, যক্ষ্মা, হাঁপানি, ব্রংকাইটিস, যক্ষ্মাসহ শ্বসতন্ত্রের আরো বেশ কিছু রোগের জীবাণু ছড়ায়। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, ঢাকার বাতাসের বিষাক্ত সিসা, কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার বাতাসের ধূলিকণায় মিশে নিঃশ্বাসের সঙ্গে শ্বাসতন্ত্রে প্রবেশ করছে অবলীলায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ গণমাধ্যমকে বলেন, সবাইকেই বুঝতে হবে—যানজট কেবল কর্মঘণ্টা নষ্ট কিংবা আর্থিক ক্ষতিই নয়, এতে শারীরিক-মানসিক মারাত্মক প্রভাব পড়ে। অনেক রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, অনেক রোগকে বাড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে বায়ুদূষণের মাধ্যমে যেসব উপাদান মানুষের শরীরে প্রবেশ করে তাতে ক্যান্সারের ঝুঁকি, যক্ষ্মা, কিডনি ও ফুসফুসের সমস্যা তৈরি করে। শব্দদূষণ-সংক্রান্ত রোগের চিকিৎসায় ব্যাপক অর্থ খরচ হয়। তাই ঢাকায় যানজট নিরসনে পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই। সঙ্গে জনসচেতনতাও বাড়াতে হবে।
তাঁর পরামর্শ হচ্ছে, ‘পরিবহন বা ট্রাফিক কর্তৃপক্ষ যেমন পরিবহন চলাচলে শৃঙ্খলা আনতে কাজ করবে, তেমনি যাত্রীদেরও উচিত যতটা সম্ভব হাঁটার অভ্যাস করা, স্বল্প দূরত্বে পরিবহন পরিহার করা, যা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো হবে, পরিবহনের ওপরও চাপ কমবে, আবার যত সময় বসে থেকে কর্মঘণ্টা নষ্ট হবে ততক্ষণে গন্তব্যের দিকে অনেকটা এগিয়ে গিয়ে সময়ও বাঁচানো যাবে।’
স্পাইন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. শাহ আলম বলেন, ‘বয়স্কদের পাশাপাশি তরুণদের মধ্যেই ব্যাক পেইন ও শোল্ডার পেইনের হার বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে যানজট। অন্য বয়সের মানুষদের জন্য যানজটে বসে থাকা তো আরো বিপদ। একটানা এক ঘণ্টা একইভাবে বসে থাকলে স্পাইনে ও ঘাড়ে প্রভাব পড়ে। ঢাকায় যানজটের প্রভাবে যে স্পাইনের সমস্যা বাড়ছে, তা আমরা রোগীদের অবস্থা দেখে এবং জীবনযাপনের ইতিহাস শুনেই নিশ্চিত হচ্ছি।’
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রতিবছর শুকনো মৌসুমে ঢাকায় ধুলা ও ধোঁয়ার দূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করে। সেই সঙ্গে পরিবহনের জ্বালানি, আশপাশের গাড়ির তাপ, শব্দ—সব মিলে এক ভয়ানক অবস্থা তৈরি হয়। আর যাঁরা প্রতিদিন বিভিন্ন পরিবহনে, বিশেষ করে বাস, টেম্পো, অটোরিকশা, মোটরসাইকেল কিংবা রিকশায় চলাফেরা করেন, তাঁদের জন্য যানজটের সময় বড় অস্বাস্থ্যকর এক পরিবেশের তৈরি হয়।
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, কোনো বাস, রিকশা কিংবা অটোরিকশার যাত্রী—এমনকি কোনো প্রাইভেট কারেও যদি গ্লাস নামিয়ে সাদা পোশাক পরে মিরপুর থেকে মতিঝিল কিংবা মতিঝিল থেকে উত্তরা অথবা গুলশান-মোহাম্মদপুর রুটে চলাচল করেন তাহলে দেখা যায়, এক ট্রিপেই ধুলা-ধোঁয়ায় পোশাকের রং পাল্টে যায়। এটা চোখে দেখা গেলেও একই ধুলা-ধোঁয়া নাক-মুখ দিয়ে শরীরের ভেতরে প্রবেশ করে বলে তা দেখা যায় না।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের স্ট্যান্ডার্ড (মান) অনুসারে বায়ুতে দূষণের মাত্রা থাকার কথা ‘পিএম-১০’ মাত্র ৫০ প্রতি কিউবিক মাইক্রোগ্রামে প্রতিবছর এবং ‘পিএম ২.৫’ থাকার কথা মাত্র ১৫ প্রতি কিউবিক মাইক্রোগ্রামে প্রতিবছর। কিন্তু বাস্তবে নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ঢাকায় ‘পিএম-১০’ থাকে ১০০-২৫০ প্রতি কিউবিক মাইক্রোগ্রামে প্রতিবছর, অন্যদিকে ‘পিএম-২.৫’ থাকে ৭০-১৬৫ প্রতি কিউবিক মাইক্রোগ্রামে প্রতিবছর।
যানজটে যাত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে স্নায়ু ও মস্তিষ্কের ওপর, যা ছড়িয়ে পড়ে শরীরের অন্যান্য জায়গায়। একপর্যায়ে যা সমষ্টিগতভাবে বিপদ ডেকে আনে।
জাতীয় নিউরো সায়েন্স ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক ও নিউরো মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. কাজী দ্বীন মোহাম্মদ গণমাধ্যমকে বলেন, ১০ মিনিটের পথ যখন অনেক বেশি সময় লেগে যায়, তখন প্রথমেই মাথা ধরে যায়, তারপর রক্তচাপ বেড়ে যায়, হাইপার টেনশন তৈরি হয়, মস্তিষ্ক চাপ অনুভব করতে থাকে, হার্টের বিট বেড়ে যায়। যানজটে আটকে থাকা সচেতন ব্যক্তিরা বুঝতে পারেন তাঁর মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর ওপর বিরাজমান অস্বাভাবিকতার প্রভাব। প্রতিনিয়ত এমন হতে হতে পর্যায়ক্রমে অনেকের মধ্যেই হার্টের রোগ, মস্তিষ্কের রোগ দেখা যায়। হার্ট ও ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।
ঢাকায় যানজট যেখানে যত বেশি সেখানে হর্নও বাজে তত বেশি। সম্প্রতি এক পর্যবেক্ষণে ঢাকা শহরের শব্দদূষণের মাত্রা সহনীয় মানমাত্রার চেয়ে দেড়-দ্বিগুণ মাপে পাওয়া গেছে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের পরিচালনায় ওই পর্যবেক্ষণে ঢাকা মহানগরীর ৪৫টি স্থানে শব্দের মাত্রা পরিমাপ করা হয়। কোথাও দিনে বেশি, কোথাও রাতে বেশি। ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকা ছাড়াও মিশ্র, আবাসিক, এমনকি নীরব এলাকায়ও একই হারে শব্দদূষণ ঘটছে বলে ওই পর্যবেক্ষণে উঠে আসে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের নাক-কান-গলা বিভাগের অধ্যাপক ডা. মহিউদ্দিন খান গণমাধ্যমকে বলেন, অনিয়ন্ত্রিত শব্দদূষণের ফলে কানের ভেতরের স্পর্শকাতর টিস্যুগুলো বিকল হতে থাকে। একপর্যায়ে ভুক্তভোগী মানুষটি শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলে। শিশু ও বয়স্করা এতে সহজে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতিরিক্ত মাত্রায় শব্দদূষণে কানের পাশাপাশি স্নায়ুর ওপরও প্রচণ্ড চাপ লাগে। হার্টে সমস্যা হয়, মস্তিষ্কে সমস্যা হয়। মানুষ দিশাহারা হয়ে পড়ে। শিশুদের মধ্যে ভীতি তৈরি হয়। আর যানজটের প্রভাবে হর্ন বাজানোর প্রবণতাও অনেক বেড়ে গেছে। সামনের গাড়ি থেমে আছে দেখেও পেছন থেকে সারি বেঁধে অনেক সময়ই হর্ন বাজাতে দেখা যায়। উন্নত বিশ্বে এভাবে হর্ন বাজানোর রেওয়াজ নেই বলেও তিনি স্মরণ করিয়ে দেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বরাত দিয়ে পরিবেশবিদরা জানান, বসতি এলাকায় শব্দের মাত্রা দিনে ৫৫ ডিবি (ডেসিবল), রাতে ৪৫ ডিবি; বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৬৫ ডিবি, রাতে ৫৫ ডিবি; শিল্পাঞ্চলে দিনে ৭৫ ডিবি, রাতে ৬৫ ডিবি এবং হাসপাতাল এলাকায় দিনে ৫০ ডিবি, রাতে ৪০ ডিবি শব্দমাত্রা থাকা উচিত। কিন্তু ঢাকায় এর মানমাত্রা স্থানভেদে ৬০ থেকে ১২০ ডিবি পর্যন্ত পাওয়া যায়।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর আওতায় শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এ আইন লঙ্ঘনের অপরাধে বিভিন্ন দণ্ডেরও বিধান রাখা হয়েছে।
অনেকে যানজটে পড়ে চালকের সঙ্গে ঝগড়ায় জড়িয়ে যান। অনেকে উত্তেজিত হয়ে কখনো নিজের ওপর রাগ ঝাড়েন, বারবার ঘড়ি দেখেন। মানসিক চাপ থেকেই হচ্ছে এমনটা। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল গণমাধ্যমকে বলেন, প্রতিদিন এমন মানসিক চাপের ফলে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা তৈরি হয়। কর্মস্থলে এবং বাসায় ফিরেও এর প্রভাব পড়ে। মেজাজ খিটখিটে থাকে, কাজে মন বসে না, অবসাদ কাজ করে—এক ধরনের অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। বিষয়টি নিয়ে সমীক্ষার চিন্তাভাবনা চলছে। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, যানজট থেকে মানসিক চাপে পড়ার বিষয়টি হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ থেকে রক্ষার জন্য উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, এ অবস্থা থেকে বাঁচতে হলে যানজট নিরসনে পথ যেমন খুঁজতে হবে, তেমনি যানজটকালে শব্দ ও বায়ুদূষণ রোধ, পরিবহন ব্যবস্থাপনায়ও পরিবর্তন আনতে হবে। পরিবহন যাত্রীদেরও সচেতন থাকতে হবে নিজ নিজ স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাপারে।
x

Check Also

বারবার রূপ বদলাচ্ছে নতুন করোনা ভাইরাস

এমএনএ ইন্টারন্যাশনাল ডেস্ক : মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া নতুন করোনা ভাইরাস এখন পর্যন্ত ১০ বার ...