এমএনএ ফিচার ডেস্ক : প্রতিবছর মে মাসের প্রথম মঙ্গলবার বিশ্বব্যাপি পালন করা হয়ে থাকে হাঁপানি দিবস। সেই অনুযায়ী এই বছর ৩ মে পালিত হচ্ছে এই আয়োজন।
ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের তথ্যানুসারে সারা বিশ্বে প্রায় ২৩৫ মিলিয়ন মানুষ এই রোগে ভুগছে। সাধারণত দেখা যায় শিশুদের মধ্যে অ্যাজমার প্রকোপ বেশি।
বিশ্বের প্রায় ২০ কোটি লোক এতে আক্রান্ত। প্রতিবছর প্রায় দুই লাখ লোক এ রোগে মৃত্যুবরণ করে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আমাদের দেশে ৭০ লাখ লোক এ রোগে ভুগছে। তাদের ৫০ শতাংশের বয়সই ১৫ বছরের নিচে।
গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ ফর অ্যাজমা বা জিআইএনএ নামক একটি সংস্থা গোটা মে মাস জুড়ে বিভিন্ন সতর্কীকরণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালন করে থাকে হাঁপানি সতর্কতা। উদ্দেশ্য হলো, বিশ্বজুড়ে হাঁপানি সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি ও এর পরিচর্যাকে জোরদার করা।১৯৯৮ সাল থেকে তারা এই আয়োজন করছে আসছে।
পাশাপাশি বাংলাদেশেও এই দিবস পালন করা হয়ে থাকে।
যদিও গত দুই দশকে অ্যাজমা রোগের চিকিৎসায় অনেক সাফল্য অর্জিত হয়েছে, এর প্রদুর্ভাব ও তীব্রতা এবং এ রোগের কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি দিন দিন বেড়েই চলেছে। পরিবেশদূষণসহ নানা জটিলতায় ফুসফুসের সংক্রমণ বাড়ছে। প্রাপ্ত একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রেই প্রায় ১২ মিলিয়ন মানুষ সিওপিডিতে আক্রান্ত। এর দুটি বিশেষ ধরন রয়েছে— এমফাইসেমা ও ব্রঙ্কাইটিস। মূলত মানুষের দুই ধরনের ফুসফুসের রোগের মধ্যে ভয়ানক হচ্ছে স্থায়ী রোগ (Chronic obstructive pulmonary disease- COPD)। পাশাপাশি অ্যাজমা বা সাধারণ হাঁপানি ও রোগ তো রয়েছেই।
অ্যাজমা বা হাঁপানি সম্পূর্ণ ভালো করার মতো ওষুধ না থাকলেও সঠিক চিকিৎসায় ও সাবধানে থাকলে এই শারীরিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
হাঁপানিতে কী হয়?
হাঁপানি হল অতি-সংবেদনশীলতা ও উত্তেজনার কারণে শ্বাসনালীর শাখা-প্রশাখাগুলোর সাময়িক সংকোচন। শ্বাসনালীগুলোর দেওয়ালে অনৈচ্ছিক পেশির একটা স্তর থাকে। উত্তেজনায় পেশিগুলো সংকুচিত হয় অর্থাৎ নালীর ভেতরটা সরু হয়ে যায়।
হাঁপানির সঠিক কারণ এখনও জানা যায়নি। এ রোগের জন্য কোনো কিছুকে এককভাবে দায়ী করা যায় না।
গবেষণায় দেখা গেছে, কারও কারও বংশগত কারণে বা পরিবেশগত কারণেও এ রোগ হতে পারে। কারও নিকটাত্মীয় যদি এতে আক্রান্ত থাকেন বা কেউ যদি বিভিন্ন দ্রব্যের প্রতি অতিমাত্রায় অ্যালার্জিক হয়, তাহলে তার হাঁপানি হতে পারে।
হাঁপানির প্রধান উপসর্গ হল —
• শ্বাসকষ্ট • কাশি • বুকে চাপ লাগা • নিঃশ্বাসে সাঁই-সাঁই আওয়াজ। আর প্রায় রাতে শ্বাসকষ্ট বাড়ে।
যে সব উত্তেজক থেকে হাঁপানির আক্রমণ শুরু হতে পারে, সেগুলো এ রকম —
• ঘরের ঝুল-ধুলোয় থাকা ডাস্ট-মাইট বা ধুলার পোকা। • কুকুর-বেড়ালের লোম, পাখীর পালক। • বাতাসে উদ্ভিদের রেণু। • সিগারেট-বিড়ির ধোঁয়া। • সেন্ট, পারফিউম। • কাজের জায়গায় ধোঁয়া ও নানা রাসায়নিক • পরিবেশ দূষণ। • অতিরিক্ত পরিশ্রম। • ঠাণ্ডা হাওয়া। • ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া-ঘটিত জীবাণুসংক্রমণ। • কিছু কিছু ওষুধ। • মানসিক আবেগ। • পাকস্থলীর অ্যাসিড গ্রাসনালী হয়ে শ্বাসনালীতে আসা।
রোগ-নির্ণয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা
• সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা হল, স্পাইরোমিটার দিয়ে ফুসফুসের কর্মক্ষমতা পরীক্ষা করা। প্রথমে পরীক্ষা করে যদি দেখা যায় কর্মক্ষমতা কম, তাহলে সালবুটামল নামক শ্বাসনালী প্রসারক (bronchodilator) দিয়ে নেবুলাইজ করে আবার পরীক্ষা করা হয়।
দ্বিতীয় বার কর্মক্ষমতায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি হলে হাঁপানির রোগ-নির্ণয় নিশ্চিত।
হাঁপানিতে যে ওষুধগুলো ব্যবহার করা হয়, সেগুলোকে দুটো প্রধান ভাগে ভাগ করা হয় — শ্বাসনালী-প্রসারক ও প্রদাহরোধী।
• শ্বাসনালী প্রসারকগুলো শ্বাসনালীর মাংসপেশির সংকোচন প্রতিহত করে শ্বাসনালীর রাস্তাকে চওড়া করে ফুসফুসে বাতাস চলাচলের পরিমাণ বাড়ায়।
• বর্তমানে বলা হয়, প্রদাহরোধী ওষুধগুলো শ্বাসের সঙ্গে নেওয়াই হল হাঁপানির দীর্ঘকালীন চিকিৎসার মূল বিষয়।
প্রখ্যাত গবেষক ট্যামি ওর্থ মনে করেন, ১১টি বিষয়ে দৃষ্টি দিলে খুব সহজে সিওপিডি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়—
ধূমপান ত্যাগ
কথায় বলে, ধূমপানে বিষপান। মনে করা হয়, সিওপিডির মতো সমস্যার ক্ষেত্রেও মূল কারণ এ ধূমপান। বলতে গেলে ধূমপান মানুষের ফুসফুসের যে স্থায়ী ক্ষতি করে তার ফল হচ্ছে সিওপিডি। মেডিকেল সেন্টার অব ডারহামের ফুসফুস বিশেষজ্ঞ নেইল ম্যাকেন্টায়ার মনে করেন, ধূমপান এড়িয়ে চলা সম্ভব হলে এ ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে ফেলা সম্ভব।
সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণ
বিশেষ কিছু লক্ষণের মাধ্যমে ফুসফুসের রোগ ও তার ধরন চিহ্নিত করা যায়। এ বিষয়গুলো খেয়াল করে উপযুক্ত চিকিত্সা গ্রহণ করা উচিত। বিশেষ করে সালমেট্রল ও ফ্লুটিকাসোনের মতো ওষুধ গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই কাজ করে না। তাই রোগীদের উচিত আগে থেকেই সতর্ক থেকে উপযুক্ত ওষুধ গ্রহণ করা।
ওজন নিয়ন্ত্রণ
উপযুক্ত ব্যায়াম ও নিয়ন্ত্রিত খাদ্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে প্রত্যেক সম্ভাব্য সিওপিডি রোগীর উচিত তার ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা। অতিরিক্ত ওজনের ব্যক্তির ফুসফুসজনিত জটিলতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বিশেষ করে ওজন বেশি হলে দ্রুত হাঁফিয়ে ওঠার প্রবণতা বহুলাংশে বেড়ে যায়।
দূষণমুক্ত পরিবেশ
যাদের নিঃশ্বাসে সমস্যা, তাদের উচিত দূষণযুক্ত পরিবেশ এড়িয়ে চলা। বিশেষ করে উগ্র গন্ধযুক্ত পারফিউম, শ্যাম্পু, কীটনাশক, মশার কয়েল, পরাগরেণু ও ধুলাবালি থেকে তাদের দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়। অনেক ক্ষেত্রে এয়ার ফ্রেশনার ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র থেকেও অ্যালার্জিজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন
ফুসফুসের সমস্যায় আক্রান্তদের উচিত নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করা। বিশেষ করে এমন খাদ্য গ্রহণ না করা কিংবা এমন পরিবেশ এড়িয়ে চলা, যা তাদের শ্বাসকষ্টের কারণ হয়। যেমন সরাসরি ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা পানি বের করে পান না করা। একইভাবে আইসক্রিমের মতো হিমায়িত খাবারগুলো এড়িয়ে চলা উচিত তাদের।
পরিমিত ঘুম
আক্রান্ত রোগীদের জন্য পরিমিত ঘুম জরুরি। বিশেষত অতিরিক্ত ঘুম ও নিদ্রাহীনতা দুটিই তাদের জন্য ক্ষতিকর। শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীদের সঙ্গে যদি স্লিপ অ্যাপনিয়ার মতো সমস্যা যুক্ত হয়, তার পরিণাম ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। এজন্য উপযুক্ত চিকিত্সা নেয়া উচিত।
ফুসফুসের জটিলতা নিরাময়
ফুসফুসে অন্য কোনো জটিলতা থাকলে তার পরিণতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। বিশেষ করে সিওপিডিতে আক্রান্ত সেসব রোগী, যাদের নিয়মিত অক্সিজেন নিতে হয়, তাদের উচিত পালমোনারি রোগ নিরাময় কেন্দ্রে গিয়ে চিকিত্সা গ্রহণ করা। সেখানে গেলে চিকিত্সকদের পরামর্শমতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাদের জানা সম্ভব হয়।
শ্বাসের ব্যায়াম
শ্বাসের অনেক ব্যায়াম আছে, যেগুলো ফুসফুসের কার্যকারিতাকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। সিওপিডি কিংবা শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত ব্যক্তি এ ব্যায়ামগুলো অনুশীলনে আনতে পারলে অনেকাংশে সুস্থতা লাভ করতে পারেন। এক্ষেত্রে ব্যায়ামের সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে। সেগুলো মেনে উপযুক্তভাবে অনুশীলন করা সম্ভব হলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
সক্রিয় থাকা
যাদের ফুসফুসজনিত সমস্যা রয়েছে, তারা একটু পরিশ্রমেই হাঁপিয়ে ওঠেন। এতে দমে গেলে চলবে না। আস্তে আস্তে নিয়ম মেনে কাজ করায় সক্রিয় থাকতে হবে। ফলে তাদের রোগের প্রকোপ ধীরে ধীরে কমে আসবে। যেমন হাঁটাহাঁটি করলে যদি হাঁপিয়ে ওঠেন, তার পরও সেটা ছেড়ে দেয়া যাবে না।
অক্সিজেন থেরাপি
দীর্ঘমেয়াদি গুরুতর শ্বাসকষ্ট রোগীদের উচিত তাদের আপত্কালীন ব্যবস্থা হিসেবে অক্সিজেনের ব্যবস্থা রাখা। বিশেষ করে হঠাৎ শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে তখনকার প্রাথমিক চিকিত্সা হিসেবে অক্সিজেন বেশ কার্যকর।
ফুসফুস প্রতিস্থাপন সম্পর্কে ধারণা রাখা
সিওপিডিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ফুসফুস প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে দুটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। প্রথমত. সরাসরি প্রতিস্থাপন এবং তার পাশাপাশি ফুসফুসের আকৃতি হ্রাস করে ফেলা। এর মাধ্যমে ফুসফুসের পুরোটা না সরিয়ে ফেলে ক্ষতিগ্রস্ত স্থান কেটে বাদ দেয়া।
এছাড়াও হাঁপানি প্রতিরোধে আরও কয়েকটি সতর্কতা
হাঁপানি শুরুর উত্তেজকগুলোর কথা মনে করুন। সেগুলোকে এড়িয়ে চললেই হাঁপানির টানের সংখ্যা অনেকটা কমানো যায়।
• পশুপাখীর মল ও লোম-পালক এড়িয়ে চলতে হবে। পশু-পাখী না পোষাই ভালো।
• ঘরের ঝুলে থাকা ধুলা-পোকা বা মেঝেতে থাকা ছত্রাক নির্মূল করা মুশকিল। তবু ঘর পরিষ্কার রাখতে হবে। ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ায় ছত্রাক বাড়ে, তাই ঘরে হাওয়া চলাচলের ব্যবস্থা থাকা চাই।
• পালকের বালিশ, উলের কম্বল ব্যবহার না করা ভালো। সপ্তাহে একদিন গরম পানিতে বালিশের ওয়াড়, চাদর, কম্বল, ইত্যাদি ধুতে হবে।
হাঁপানি রোগীর ভবিষ্যৎ
• যেসব রোগীর রোগ মৃদু ধরনের এবং ছোট বয়সে শুরু হয়, তাদের সাধারণত বয়স বাড়লে এই রোগ ভালো হয়ে যাওয়ার শতকরা ৫০ থেকে ৮০ ভাগ সম্ভাবনা থাকে।
হাঁপানির ওষুধ সঠিকভাবে ব্যবহার করলে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবন যাপন সম্ভব। এই অবস্থা সম্পূর্ণ ভালো করার জন্য এখনও কোনো ওষুধ বের হয়নি। তবে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে হাঁপানি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।