এমএনএ অর্থনীতি রিপোর্ট : দেশব্যাপী করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়ার মধ্যেই আজ থেকে খুলছে পোশাককারখানা। আজ রবিবার শুরুতে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জের নিটওয়্যার খাতের কিছু কারখানা খুলবে। এরপর ধাপে ধাপে সাভার, গাজীপুরসহ অন্যান্য এলাকার কারখানা খুলবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কারখানা খোলার ক্ষেত্রে কী ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, তা নিয়ে পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ একটি গাইডলাইন তৈরি করেছে। ঐ গাইডলাইন অনুযায়ী, দূরবর্তী এলাকা কিংবা ঢাকার বাইরে চলে যাওয়া শ্রমিকদের বাদ দিয়ে আপাতত কারখানার কাছাকাছি থাকা শ্রমিকদের দিয়ে উৎপাদনকাজ চালানো হবে।
গতকাল শনিবার ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই দেশের সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে একটি সভার আয়োজন করে। ঐ সভায় আজ থেকে কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত হয়। সভায় উপস্থিত একাধিক ব্যবসায়ী নেতা গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। সভায় উপস্থিত বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন গণমাধ্যমকে বলেন, রবিবার থেকে একেবারেই স্বল্প পরিসরে কারখানা খোলা হবে। দূরের কোনো শ্রমিককে আনা হবে না। এরপর গণপরিবহন চালু হলে দূরের শ্রমিকদের উৎপাদনকাজে যুক্ত করা হবে।
বিকেএমইএর সিনিয়র সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম গণমাধ্যমকে বলেন, জীবন-জীবিকার তাগিদে রবিবার থেকে স্বল্প পরিসরে কিছু কারখানার কার্যক্রম চালু করা হবে। শুরুতে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার কিছু কারখানা এবং নারায়ণগঞ্জের কিছু নিটিং, ডায়িং কারখানা চালু করা হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে অন্যান্য এলাকায় খোলা হবে।
পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ড. রুবানা হক কারখানা খোলার বিষয়টি অবহিত করে শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। ঐ চিঠিতে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশ ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালু করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সংগঠনের সদস্যভুক্ত কারখানাগুলো পর্যায়ক্রমে খোলা হচ্ছে। শুরুতে আজ ও আগামীকাল ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কিছু কারখানা; ২৮ থেকে ৩০ এপ্রিল আশুলিয়া, সাভার, ধামরাই ও মানিকগঞ্জের কারখানা; ৩০ এপ্রিল রূপগঞ্জ, নরসিংদী, কাঁচপুর এলাকা; ২ ও ৩ মে গাজীপুর ও ময়মনসিংহ এলাকার কারখানা চালু করা হবে। কারখানা খোলার ক্ষেত্রে শুরুতে উৎপাদনক্ষমতার ৩০ শতাংশ চালু করা হবে। পর্যায়ক্রমে তা বাড়ানো হবে।
এই চিঠি পাওয়ার পর শ্রম মন্ত্রণালয়ও তাৎক্ষণিক একটি চিঠি ইস্যু করেছে। এতে সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা চালু করার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়।
অবশ্য মালিকপক্ষ কারখানা চালুর সিদ্ধান্ত নিলেও শ্রমিক সংগঠনগুলো বর্তমান করোনা ভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী পরিস্থিতিতে কারখানা চালু না করার পক্ষে। তারা বলছেন, এতে বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের (আইবিসি) সাবেক মহাসচিব কুতুবউদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী, ইতিমধ্যে দুই শতাধিক শ্রমিক করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কারখানা খুললে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। কোনো ক্রমেই কারখানা খোলা উচিত হবে না।’
সূত্র জানিয়েছে, গতকালের সভায় গণমাধ্যমের প্রতিনিধি ছাড়াও অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা তাদের মতামত তুলে ধরেন। করোনা ভাইরাসের পরিস্থিতিতে অনেকে নিজে উপস্থিত না হয়ে অনলাইনে ভিডিওতে যুক্ত হয়ে তাদের মতামত তুলে ধরেন। সভায় বক্তারা দেশের অর্থনীতির স্বার্থে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সরবরাহ চেইন সচল রাখার তাগিদ দেন।
ঐ সভায় অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর ঢালাওভাবে সব এলাকার কারখানা না খুলে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের হার বিবেচনায় অপেক্ষাকৃত নিরাপদ এলাকার কারখানা খোলার পর পর্যায়ক্রমে অন্যান্য এলাকায় খোলার পরামর্শ দেন। এজন্য গ্রিন, ইয়েলো ও রেড জোন হিসেবে ভাগ করার কথা বলেন।
সভা শেষে গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, এপ্রিলে রপ্তানি আদেশ কমে গেছে ৮৪ শতাংশ। সুতরাং যত কম শ্রমিক দিয়ে কাজ শুরু করা যায়, সেই চেষ্টা করা দরকার। করোনা ভাইরাসের বর্তমান পরিস্থিতিতে সব এলাকার কারখানা খোলার ক্ষেত্রে ঝুঁকি আছে।
শিল্পাঞ্চল পুলিশের প্রধান আব্দুস সালাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কারখানা খোলার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানি। তবে এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা এলে তার ভিত্তিতে কাজ করব।’
বিজিএমইএর একজন ঊর্ধ্বতন নেতা গণমাধ্যমকে জানান, প্রায় সব কারখানার মালিকই জানিয়েছেন তারা কারখানা চালু করতে চান।
সূত্র জানিয়েছে, এলাকাভিত্তিক কারখানা খোলার বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছে শিল্পাঞ্চল পুলিশ। বিশেষত কোন এলাকা অপেক্ষাকৃত ঝুঁকিপূর্ণ—এ ধরনের তালিকা তৈরি করছে শিল্পাঞ্চল পুলিশ।
শিল্পাঞ্চল পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের হিসাবে এখন পর্যন্ত গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন খাতের ২০০ থেকে ২৫০ জন শ্রমিক করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে।’
অবশ্য বিজিএমইএর পরিচালক ও তুসুকা গার্মেন্টসের চেয়ারম্যান আরশাদ জামাল দীপু মনে করেন, গার্মেন্টসে করোনায় আক্রান্ত শ্রমিকের সংখ্যা এত হবে না। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘বেশিসংখ্যক শ্রমিক আক্রান্ত হলে নিশ্চয়ই এসব খবর চাপা থাকত না। তিনি বলেন, শ্রমিকদের কারখানায় প্রবেশের ক্ষেত্রে থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপ করা, জীবাণুমুক্ত করা, কমসংখ্যক শ্রমিক দিয়ে কাজ চালানো এবং শ্রমিকদের মধ্যে পাঁচ ফুট দূরত্ব নিশ্চিত করাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হবে। এছাড়া শিল্পাঞ্চলগুলোতে শ্রমিকের করোনা পরীক্ষা করার বিষয়ে আলাদা ব্যবস্থা করার বিষয় নিয়েও আলোচনা চলছে।
এর আগে সরকার ২৫ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর পোশাকশিল্পও বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে পরবর্তী খোলার তারিখে শ্রমিকদের কারখানায় আসার নোটিশ দেওয়ার পর দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শ্রমিকদের ঢাকামুখী স্রোত শুরু হয়। সমালোচনার মুখে পরবর্তী সময়ে কারখানা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় বিজিএমইএ। তবে এর মধ্যেই কারখানা চালু করার উপায় খুঁজতে থাকেন কারখানার মালিকেরা।