ছাত্রলীগের নৈরাজ্যে সংকটে ছাত্ররাজনীতি
Posted by: News Desk
September 9, 2019
দেশের সবচেয়ে পুরনো ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া ঐতিহ্যবাহী এ সংগঠনটির গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। স্বাধীনতা উত্তরকালে আশির দশকে সামরিক স্বৈরাচারকে হটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে সংগঠনটি। নব্বই দশকের শুরুতেও যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্র-যুব-সামাজিক আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ছাত্রলীগ। কিন্তু বিগত দুই দশকেরও বেশি সময়ে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ছাত্রসমাজের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামে ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্রসংগঠনটির ভূমিকা এবং ছাত্রবান্ধব কর্মসূচি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও খুব একটা দৃশ্যমান নয়।
ছাত্র আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ধারা থেকে সরে এসে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির অনিবার্য পরিণতিতে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে পড়া, টেন্ডারবাজি ও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়াসহ মাদকাসক্তি ও যৌন নিপীড়নের নানা অভিযোগে অভিযুক্ত হতে থাকে এই ছাত্রসংগঠনটির বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী। রাজনীতির এ সমীকরণে সংগঠনের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা দিন দিন কমতে থাকায় নেতা নির্বাচনের প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে নানা ক্ষেত্রে সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা বেড়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগে। এসব কারণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে জেলা পর্যায়ের কলেজ এবং বিভিন্ন শহর-নগরের সাংগঠনিক কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপের দ্বন্দ্ব-সংঘাতে হতাহতের ঘটনার সংখ্যা নেহাত কম নয়। একই সঙ্গে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ছাত্র নিপীড়ন ও সন্ত্রাসী হামলায় হতাহতের ঘটনায় বিভিন্ন সময়ে দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা দেখা গেছে।
নানা সময়ে এসব আলোচিত-সমালোচিত হলেও বিগত বছরগুলোতে ছাত্রলীগের নৈরাজ্য এতটাই মারাত্মক আকার ধারণ করেছে যে, আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা ছাত্রসংগঠনটির নেতাকর্মীদের সমালোচনায় উচ্চকণ্ঠ হয়েছেন। সর্বশেষ, গত শনিবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সভায় ছাত্রলীগের প্রসঙ্গ উঠলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর দৃশ্যত ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রসংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দিতে বলেছেন বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী শনিবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি তাদের সাক্ষাৎ দেননি। তিনি ছাত্রলীগের সংকট নিরসনে ছাত্রলীগের দুই সাবেক শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন। ছাত্রলীগের প্রতি আস্থার সংকটের বিষয়টিকে আওয়ামী লীগ সভাপতির গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া অবশ্যই সুবিবেচনার পরিচায়ক।
গত বছর ১১ ও ১২ মে ছাত্রলীগের সম্মেলনের পর ৩১ জুলাই আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মতিতে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে সভাপতি ও গোলাম রাব্বানীকে সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করা হয়। একই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংসদ কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নামও ঘোষণা করা হয়। দ্রুততম সময়ে কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করার কথা থাকলেও তাতে ব্যর্থ হয় ছাত্রসংগঠনটির নেতারা। শুধু তাই নয়, কমিটি গঠন নিয়ে অসন্তোষ এতটাই তীব্র আকার ধারণ করে যে এ নিয়ে সংঘাত সহিংসতায় রূপ নেয় এবং সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিবাদ জানান পদপ্রত্যাশী নেতাকর্মীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টানা কয়েক দিনের অনশনের ঘটনাও ঘটে ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের সংকটকে কেন্দ্র করে। একদিকে সংগঠনের এসব অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও ব্যর্থতা; আরেকদিকে সাম্প্রতিক কোটা-সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন ও ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রসংগঠনটির নেতাকর্মীদের বিতর্কিত ভূমিকা এবং বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনায় ছাত্রসমাজের পাশাপাশি নাগরিকদের মধ্যেও ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
বিশেষত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসুর বহু প্রতীক্ষিত নির্বাচন দেশের ছাত্ররাজনীতিতে সুবাতাসের যে সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ভূমিকার মূল্যায়ন হওয়া জরুরি। দীর্ঘ ২৯ বছরের অচলাবস্থা ভেঙে মার্চ মাসে নির্বাচনের মাধ্যমে যে ডাকসু সচল হলো তার কোনো ইতিবাচক ফল ছাত্ররাজনীতিতে দেখা যাচ্ছে না। জিএস-এজিএসসহ ডাকসুর ২৫টি পদের ২৩টিতেই ছাত্রলীগ প্যানেলের প্রার্থীরা নির্বাচিত হওয়ায় ডাকসুর দৃশ্যমান ব্যর্থতার দায় ছাত্রলীগের ওপরই বর্তায়। উপরন্তু এখন সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিতে ভর্তি পরীক্ষা না দিয়েই জালিয়াতির মধ্য দিয়ে সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি হন ছাত্রলীগের ৩৪ নেতা, যাদের মধ্যে ৮ জন ডাকসু ও হল সংসদের নেতা। উদ্ভূত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ডাকসু ব্যর্থ হলে তা কেবল ছাত্রলীগের জন্যই নয়, দেশের ছাত্ররাজনীতির জন্যও অশনিসংকেত হয়ে দেখা দেবে। এ অবস্থায় ক্ষুদ্রতম ইউনিট থেকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পর্যায়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে পুনর্গঠনের লক্ষ্যে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের অংশগ্রহণের সুযোগকে অবারিত করা এবং সংগঠনটির সকল পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালানো প্রয়োজন।
ছাত্রলীগের সংকটে নৈরাজ্যে ছাত্ররাজনীতি 2019-09-09