এমএনএ রিপোর্ট : বিশ্ববাসীকে স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতন করতে ১৯৫০ সাল থেকে পালিত হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্যসেবা দিবস। আজ মঙ্গলবার (৭ এপ্রিল) বিশ্ব যখন দিবসটি পালন করবে, তখন সারা দুনিয়া লড়ছে কভিড-১৯ মহামারির বিরুদ্ধে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য- ‘নার্স ও ধাত্রীদের সহায়তা’।
বর্তমানে বিশ্বে প্রতি বছর সামরিক খাতে ব্যয় হয় এক লাখ ৮০ হাজার কোটি ডলার। আগামী ২০ বছরে নতুন মারণাস্ত্র তৈরিতে খরচ হবে আরও এক লাখ কোটি ডলার। বিশ্বে গড়ে মাথাপিছু সামরিক ব্যয় ২৩৯ ডলার। এর বিপরীতে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় খুবই অপ্রতুল?
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (সিপ্রি) হিসেবে দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো স্বাস্থ্যসেবার চেয়ে বেশি ব্যয় করে সামরিক খাতে। এর অবশ্যম্ভাবী ফলও দেখা গেছে করোনা ভাইরাস মহামারিতে। যেসব দেশকে সামরিক দিক থেকে অজেয় মনে করা হয়, তারাও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র করোনা ভাইরাসের কাছে চরম অসহায়। যেসব দেশ শত্রুর বিরুদ্ধে মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর যুদ্ধ করার রসদ মজুদ করেছে, তাদের কাছেও করোনা ভাইরাস পরীক্ষার কোনো কিট ছিল না। ফলে প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুও ঠেকানো যাচ্ছে না। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না।
নিকট অতীতে করোনার মতো মহামারি বিশ্ব আর দেখেনি। এর আগে সার্স, মার্স, ইবোলা কিংবা এইডসের মতো মহামারির প্রভাব এতটা ভয়ংকর ছিল না। তা ছিল না সর্বব্যাপী ও সর্বগ্রাসী। তবে করোনা ভাইরাসের মতো মহামারি যে আসছে- সে সম্পর্কে অনেক আগেই সতর্ক করেছিলেন বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা। তাতে কেউ কান দেয়নি। অবশ্য যেসব দেশ স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করেছে, তারা করোনা সংকট মোকাবিলায় সাফল্য দেখাচ্ছে। যেমন জার্মানি স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় বাড়িয়েছিল বলে করোনায় দেশটিতে প্রাণহানি সামান্যই।
অবস্থায় বিশ্বে সামরিক খাতে ব্যয় কমিয়ে স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ বাড়ানোর জোর দাবি উঠেছে। ইন্টারন্যাশনাল পিস ব্যুরো নামে একটি নোবেলজয়ী প্রতিষ্ঠান বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে বলেছে, সামরিক ব্যয় নাটকীয়ভাবে হ্রাস করে স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক ও পরিবেশ রক্ষায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। ১৯১০ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী এ প্রতিষ্ঠানটি গত সপ্তাহে বলেছে, সামরিক খাতে ব্যয় সামান্য কমালেই মানব জাতির সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। এ জন্য নিরস্ত্রীকরণের ওপর জোর দিয়েছে সংস্থাটি।
সামনে ১০ চ্যালেঞ্জ : করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের প্রেক্ষাপটে বিশ্ব স্বা স্থ্য সংস্থা বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে ১০টি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে। সংস্থাটি বলেছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, সংঘাতময় অঞ্চল এবং অন্যায্য স্বাস্থ্যসেবা প্রধান বাধা। এর মধ্যে অনেক চ্যালেঞ্জ আন্তঃসংযুক্ত এবং এটা মোকাবিলায় দরকার আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা। বিশেষজ্ঞরা উদ্বিগ্ন যে, এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশ্বনেতারা প্রয়োজনীয় তহবিল বরাদ্দে ব্যর্থ হচ্ছেন।
সংস্থাটির মতে, ১০টি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- জলবায়ু সংকট জনস্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। কার্বন ডাই-অক্সসাইড নিঃসরণের কারণে বছরে মারা যাচ্ছে ৭০ লাখ মানুষ। সংঘাতময় অঞ্চলে স্বাস্থ্যকর্মীরাও আক্রান্ত ও নিহত হচ্ছেন। আর লাখ লাখ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা থেকে। ধনী-দরিদ্রের মধ্যে চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তিতে রয়েছে বড় ধরনের বৈষম্য। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ওষুধ ও টিকার সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সংক্রামক রোগে বছরে মারা যাচ্ছে লাখো মানুষ। তাদের বেশিরভাগই দরিদ্র।
এ ছাড়া ভবিষ্যৎ মহামারির মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কোনো প্রস্তুতি না থাকা, ভেজাল পণ্যের ব্যবহার, স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য অপ্রতুল বরাদ্দ, স্বাস্থ্যসেবায় জনগণের আস্থা অর্জনও বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সংস্থাটি বিশ্বকে এসব হুমকি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছে।
করোনা মোকাবিলায় সর্বশক্তি নিয়োগ, টিকা আবিস্কারে জোর তৎপরতা : এবার যখন বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালিত হচ্ছে, তখন করোনার ছোবলে বিশ্ব লণ্ডভণ্ড। এখন পর্যন্ত এ রোগের কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতির সন্ধান মেলেনি। ফলে রোগটি প্রতিরোধের ওপরেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য করোনার টিকা বা ভ্যাকসিন আবিস্কারের জন্য জোর তৎপরতা চলছে। বিশ্বে ২০টির বেশি কোম্পানি টিকা তৈরিতে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। প্রাথমিক সাফল্যও পেয়েছে কয়েকটি কোম্পানি। তবে নানা ধাপ পেরিয়ে টিকা পেতে বিশ্বকে আরও অন্তত এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। তাই ভ্যাকসিন তৈরির আগে অ্যান্টিবডি তৈরির চেষ্টা চলছে। কেউ কেউ এ ক্ষেত্রে সাফল্যেরও দাবি করেছে। মানবদেহ কোষে করোনা ভাইরাস প্রবেশের ক্ষমতা রোধ করার মতো অত্যন্ত কার্যকর কয়েকটি অ্যান্টিবডি পৃথক করার কথা জানিয়েছেন চীনের এক দল বিজ্ঞানী। এগুলো কভিড-১৯ এর চিকিৎসা ও প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
বেইজিংয়ের সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝাং লিনছি জানান, তার টিম যে ধরনের অ্যান্টিবডি পেয়েছে, সেগুলো দিয়ে তৈরি করা একটি ওষুধ বর্তমানে ব্যবহূত পদ্ধতির চেয়ে আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। প্লাজমার মতো ‘বর্ডারলাইন’ চিকিৎসায় এটি ব্যবহার করা যেতে পারে। ঝাংয়ের টিম এখন সবচেয়ে কার্যকর অ্যান্টিবডিগুলো শনাক্ত করার কাজে মনোনিবেশ করেছে এবং এগুলোর সংমিশ্রণ তৈরি করে করোনা ভাইরাসের পরিবর্তনের ঝুঁকি হ্রাস করার চেষ্টা করবে। অগ্রগতি সন্তোষজনক হলে প্রথমে প্রাণীর ওপর, তার পর মানুষের ওপর ওষুধটির কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হবে। এর পর আগ্রহী উৎপাদকরা ওষুধটির উৎপাদন শুরু করতে পারবেন।
এদিকে চীনে ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় জাপানের ফুজি ফিল্ম হোল্ডিং গ্রুপের একটি কোম্পানির আবিস্কার এভিগানের ব্যবহার অনেক রোগীকে রোগমুক্ত হতে সাহায্য করে। ফলে চীনে এখন করোনা ভাইরাসের চিকিৎসায় এভিগানের প্রয়োগ অব্যাহত আছে। এভিগান তৈরিই হয়েছিল সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার চিকিৎসার জন্য। করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে এর ব্যবহারিক সাফল্য অনেকটা কাকতালীয় মনে করছে ওষুধের উদ্ভাবক কোম্পানি। তবে এর রাসায়নিক উপাদানে কিছুটা রদবদল করে এটাকে করোনা ভাইরাস চিকিৎসার উপযোগী করে তোলার জন্য কোম্পানির গবেষকরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। গত সপ্তাহে ১৯ রোগীর ওপর এর ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা চালানো হয়। পরীক্ষা সফল প্রমাণিত হলে জাপান সরকার এটি ব্যবহারের অনুমতি দেবে।
করোনা ভাইরাসের টিকা গ্রহণ করলে এ ভাইরাসের সংস্পর্শে এলেও মানুষ অসুস্থ হবে না। যত বেশি সংখ্যক মানুষকে টিকা দেওয়া যাবে ততই ভালো। মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশকে টিকা দেওয়া হলে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়বে না। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এক ব্যক্তির দেহে পরীক্ষামূলক করোনা ভাইরাসের টিকা দেওয়া হয়েছে। যে কোনো টিকা আবিস্কার করলে সেটি প্রথমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় যে কোনো প্রাণীর ওপর। এ ক্ষেত্রে বিশেষ অনুমোদন নিয়ে প্রথমেই তা মানুষের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে।