Don't Miss
Home / আজকের সংবাদ / অর্থনীতি / ব্যাংক-বীমা / নজিরবিহীন পুঁজিসংকটে বেসরকারি ব্যাংকখাত

নজিরবিহীন পুঁজিসংকটে বেসরকারি ব্যাংকখাত

এমএনএ অর্থনীতি রিপোর্ট : বেশ কিছুদিন থেকে বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংকে নজিরবিহীন অর্থসংকট চলছে। বর্তমানে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে ঠেকেছে যে, বড় কোনো চেক এলে কোনো কোনো ব্যাংক টাকা দিতে পারছে না। ক্ষেত্রবিশেষে এমনও শোনা যাচ্ছে, ৫ লাখ টাকার চেক রিলিজ করতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এছাড়া শিল্প প্রতিষ্ঠানসহ বড় কোনো খাতে অনেক ব্যাংক ঋণ দেয়ার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। কোনো কোনো ব্যাংক অনুমোদিত ঋণের অর্থও দিতে পারছে না। এসব খবর শুনে নানা শঙ্কায় সাধারণ গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে। অনেকে তাদের এফডিআর ভেঙে ফেলছেন।
এদিকে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বেসরকারি ব্যাংকে রাখা তাদের বাল্ক ডিপোজিট সরিয়ে নিচ্ছে। কোনো ব্যাংক তা পরিশোধে গড়িমসি করলেও চাপ প্রয়োগ করে টাকা ফেরত দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। প্রশ্ন হল- তাহলে প্রতিটি ব্যাংকে সাধারণ আমানতকারীদের রাখা হাজার হাজার কোটি টাকা গেল কোথায়?
উদ্বেগের সঙ্গে এমন প্রশ্ন উত্থাপন করে কয়েকজন ব্যাংক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক গতকাল বুধবার গণমাধ্যমকে বলেন, বেশির ভাগ ব্যাংকে কমবেশি ২০-৩০ হাজার কোটি টাকা পুঁজি থাকার কথা। এগুলো সাধারণ মানুষের গচ্ছিত টাকা। ব্যাংক তার নিয়মানুযায়ী এসব টাকা ঋণ দিয়ে ব্যবসা করে থাকে। যথানিয়মে এ পদ্ধতি চালু থাকলে কখনও কোনো ব্যাংকের অর্থ সংকটে পড়ার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে তা তো হয়নি। প্রথমদিকে অনিয়ম দুর্নীতি করে যাকে তাকে বাল্ক প্যাকেজে ঋণ দেয়া হয়। ফলে এসব ঋণগ্রহীতা এখন খেলাপি। অথচ এসব গুরুতর অপরাধে কারও কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। এ কারণে তা পরবর্তীতে আরও ভয়াবহ রূপ নেয়।
বেশির ভাগ ব্যাংকের পরিচালক তথা মালিক পক্ষ ভাগাভাগি করে একজন আরেকজনের ব্যাংক থেকে মোটা অংকে ঋণ নিয়েছে। কেউ কেউ বেনামেও টাকা সরিয়ে ফেলেছে। এলসি খুলে কোনো পণ্য না এনে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বিশেষ প্রভাবশালীরা। এ রকম অপরাধ করেও কাউকে জবাবদিহি করতে হয়নি। জেলও খাটতে হচ্ছে না। বরং দিব্বি বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে এ চক্রের হোতারা। এভাবে গত এক দশক থেকে ব্যাংকে ঋণখেলাপি ও জালিয়াতির পরিমাণ ক্রমেই বেড়েছে। এখন যা বিপদসীমায় অতিক্রম করেছে।
তারা বলেন, এর ফলে ব্যাংকের মতো দেশের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর আজ এমন বিপর্যয়পূর্ণ পরিস্থিতিতে আটকা পড়েছে। কেউ কেউ বলছেন, দ্রুত এই অপরাধীদের শক্ত হাতে দমন করতে না পারলে এ সেক্টর হঠাৎ বালুর বাঁধের মতো ধসে পড়বে। তখন লাখ লাখ আমনতকারী রাস্তায় নেমে পড়লে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তখন সব দায় সরকারের কাঁধে এসে ভর করবে।
নজিরবিহীন এই তারল্য সংকট প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ গণমাধ্যমকে বলেন, প্রাইভেট ব্যাংকের তারল্য সংকটের জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম উপেক্ষা করে তারা বেপরোয়াভাবে ঋণ দিয়েছে।
জানতে চাইলে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম গণমাধ্যমকে বলেন, গত কয়েক বছর ব্যাংকিং খাতে যে লুটপাট হয়েছে, তার খেসারত এখন ভালো ব্যবসায়ীদের দিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, একদিকে ব্যাংকে ঋণ দেয়ার মতো পর্যাপ্ত টাকা নেই। অন্যদিকে ঋণের উচ্চ সুদহারের কারণে ব্যবসায়ীরা দিশেহারা।
তিনি আরও বলেন, যারা সততার সঙ্গে তিলে তিলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, তারা আজ ঋণ পাচ্ছেন না। অথচ অস্তিত্বহীন, নাম না জানা হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা ভূঁইফোড় প্রতিষ্ঠানের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এসবই ঋণ অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে হয়েছে। সরকারের উচ্চমহলের হস্তক্ষেপ কামনা করে তিনি বলেন, ব্যাংক লুটেরাদের শাস্তি দিতে হবে। তা না হলে ব্যাংকিং খাতসহ শিল্প প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যাবে।
বিভিন্ন ব্যাংক ও ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি খাতের বেশ কিছু ব্যাংকের কাছে নতুন ঋণ দেয়ার মতো কোনো অর্থ নেই। এমনকি আগের অনুমোদিত ঋণও টাকার অভাবে ছাড় করতে পারছে না।
একজন ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, একটি নতুন ব্যাংকের কাছে ৬০ কোটি টাকার অনুমোদিত ঋণ চেয়ে পাওয়া যায়নি।
অপর একজন ব্যবসায়ী জানান, তিনি পুরনো একটি ব্যাংকের কাছে ৬৫ কোটি টাকা অনুমোদিত ঋণ পাননি। বেশির ভাগ ব্যাংকেরই এখন এমন পরিস্থিতি বলে জানান তারা। এছাড়া ফারমার্সসহ কোনো কোনো ব্যাংক এফডিআরের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না।
এ প্রসঙ্গে ব্যাংকগুলোর এমডিদের সংগঠন-অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, খেলাপি ঋণ ছাড়াও ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে টাকার ওপর চাপ পড়েছে। এছাড়াও বাস্তব কিছু কারণে তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। তবে এটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ব্যাংকগুলোতে চলছে ভয়াবহ তারল্য সংকট। আর এ সংকট পূরণে আমানত সংগ্রহ অভিযানে নেমেছে ব্যাংকগুলো। প্রত্যেকটা ব্যাংকই তাদের কর্মকর্তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রা (টার্গেট) দিয়ে দিয়েছে। আমানত সংগ্রহের সুবিধার্থে বাড়তি সুদের স্কিমও ঘোষণা করছে ব্যাংকগুলো। সরকারি ও বিদেশি মালিকানার ব্যাংকগুলো এক্ষেত্রে কিছুটা স্বস্তিতে থাকলেও বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো এমন অভিযানে নেমেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের এমডি গণমাধ্যমকে বলেন, ফারমার্স ব্যাংকে মালিকদের লুটপাটের কারণে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। ফারমার্স ব্যাংক গ্রাহকের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তার মাসুল দিয়ে যাচ্ছে পুরো ব্যাংকিং খাত। অবিশ্বাসের জন্ম দেয়া ফারমার্সের কারণে বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে সরকারি সব আমানত তুলে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ আর বেসরকারি ব্যাংককে বিশ্বাস করতে পারছে না। নতুন করে কেউ আমানতও দিতে চাইছে না।
ব্যাংকগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বেসরকারি একটি ব্যাংকের মধ্যম সারির এক কর্মকর্তাকে গড়ে প্রতিমাসে ৫০ লাখ টাকা আমানত সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে। হিসাব করলে দেখা যায়, প্রতিদিন প্রায় দুই লাখ টাকা করে আমানত সংগ্রহ করতে হবে এ সারির একজন ব্যাংকারকে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আরও বেশি লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। কিন্তু তারা সম্ভাব্য বিভিন্ন স্থানে ধরনা দিয়েও এই হারে আমানত রাখার মতো লোক জোগাড় করতে পারছেন না। এর ফলে ব্যাপক মানসিক চাপে রয়েছেন ব্যাংকাররা।
ব্যাংকের তারল্য সংকট এখন এমনই দাঁড়িয়েছে যে, দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর মতো অর্থও অনেক ব্যাংকে নেই। এ অবস্থায় অন্য ব্যাংকের কাছ থেকে ধার নিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ সারতে হচ্ছে। এজন্য আন্তঃব্যাংক কলমানি সুদহার প্রায় সাড়ে চার শতাংশ হয়ে গেছে, যা ২০১৫ সালের নভেম্বরের পর সর্বোচ্চ। আমানতের সুদহার ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ার কারণে এমন পরিস্থিতি হয়েছে।
এদিকে আমদানি-রপ্তানিসহ অন্য প্রায় সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাংকের টাকায় পরিচালিত হয়। এসব কার্যক্রমের জন্য চুক্তি মোতাবেক অর্থ চেয়ে পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। ফলে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিভিন্ন ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় সব ব্যাংকই আমানতের সুদহার বাড়িয়েছে। বিশেষ করে যেসব ব্যাংকের আমানত তুলনামূলক কম তারা বেশি বাড়িয়েছে। বেসরকারি খাতের নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলো এক্ষেত্রে বেশি এগিয়ে রয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে সুদ ১৪ শতাংশ পর্যন্তও দেয়া হচ্ছে, যা গত এক মাস আগেও এ হার ছিল এক অঙ্কের ঘরে। অর্থাৎ ৯ শতাংশের মধ্যে। অন্যদিকে নতুন ব্যাংকের পাশাপাশি পুরনো ব্যাংকগুলোও আমানতে এখন ১০ থেকে ১১ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে।
মূলত অপরিকল্পিতভাবে ঋণ বিতরণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মে ঋণ ও আমানত রেশিও (এডিআর) সমন্বয়, ডলার বাজারে দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতা, ফারমার্স ব্যাংক কাণ্ডে গ্রাহকদের আস্থাহীনতায় বেসরকারি ব্যাংক থেকে সরকারি আমানত তুলে নেয়া ও ব্যাসেল-৩-এর (মূলধন সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড) আওতায় বাড়তি মূলধন সংরক্ষণ করতে গিয়ে অধিকাংশ ব্যাংকে তারল্য এ সংকট তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, গত বছরের শেষের দিকে ব্যাংকিং খাতে এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা অলস তারল্য ছিল। গত কয়েক মাসে ঋণ বিতরণের ফলে তা ৮৬ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ ঋণই গেছে সরকারি ব্যাংক থেকে। গত বছর ব্যাংকগুলো ৮৫ হাজার ৯১১ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে। কিন্তু ঋণ বিতরণ করেছে এক লাখ ৩১ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ আমানতের তুলনায় ৪৫ হাজার ৪১২ কোটি টাকা বেশি ঋণ বিতরণ করেছে। এতে অলস অর্থ চলে গেছে।
এদিকে তারল্য সংকট সামাল দিতে এরই মধ্যে আকর্ষণীয় মুনাফায় আমানত সংগ্রহের ঘোষণা দিয়ে মাঠে নেমেছে বেশ কিছু ব্যাংক। এগুলোর তালিকায় রয়েছে নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক ও সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক। তবে ব্যাংকাররা বলছেন, আস্থা সংকটের কারণে এভাবে কাক্সিক্ষত আমানত সংগ্রহেও কাজ হচ্ছে না। কারণ ফারমার্স ব্যাংক গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না বলে বেশির ভাগ মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে।
x

Check Also

তথ্য চুরির আশঙ্কায় ২ হাজার এটিএম বুথ

এমএনএ অর্থনীতি রিপোর্ট : দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে আনুমানিক ২ হাজার এটিএম বুথের যন্ত্র সরবরাহকারী যুক্তরাষ্ট্রের ...