Don't Miss
Home / হোম স্লাইডার / বাংলাদেশে মহামারীর চেয়েও ভয়ঙ্কর মূর্তিতে আবির্ভূত সড়ক দুর্ঘটনা
সড়ক দুর্ঘটনা

বাংলাদেশে মহামারীর চেয়েও ভয়ঙ্কর মূর্তিতে আবির্ভূত সড়ক দুর্ঘটনা

এমএনএ ফিচার ডেস্কঃ বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা মানুষের জীবনের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে। প্রতি বছর হাজারও মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করছে।ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলো মুখোমুখি হচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার। মানবসৃষ্ট এই সমস্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব পড়ছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েও কোনভাবেই বাংলাদেশে সড়ক নিরাপদ হচ্ছে না। রোগে মৃত্যুর চেয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও আহতের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা কোভিড-১৯ এর চেয়েও ভয়াবহ। তাই সড়কে দুর্ঘটনা রোধ করতে এবং ক্ষতিগ্রস্থদের ক্ষতিপূরণ দিতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।

সারা বিশ্বে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ১.২ মিলিয়ন মানুষ মারা যায় এবং আহত হয় ৫০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ। অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ২০ জন মানুষ মারা যাচ্ছে। বেপরোয়া গাড়ি চালানো, ওভারলোডিংই সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ। এছাড়া বাংলাদেশে মোটরবাইকের দুর্ঘটনা সবচেয়ে বেশি।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন (আরএসএফ) তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও আহতের ঘটনা ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ছাড়াও সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ ৯৬.৩১ বিলিয়ন টাকা। আরএসএফ এর তৈরি একটি বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৬,২৮৪ জন নিহত এবং ৭,৪৬৮ জন আহত হয়েছে এবং ২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫,৪৩১ জন নিহত এবং ৭,৩৭৯ জন আহত হয়েছে।

এই সময়ের মধ্যে, ২০২১ সালে মোট সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫৩৭১টি এবং ২০২০ সালে ৪৭৩৫টি, এইসব দুর্ঘটনার মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় অন্তত ৩৫.২৩ শতাংশ মানুষ নিহত হয়েছে। মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গাড়ি চালানো, অদক্ষ চালক, মানসিক ও শারীরিক অসুস্থতা, চালকদের জন্য অপ্রতুল সুবিধা, মহাসড়কে যানবাহনের ধীরগতি, বেপরোয়া বাইক চালানো, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এবং ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সচেতনতার অভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে।

অনেক পশ্চিমা দেশ এবং কিছু এশিয়ান দেশ বিশেষ করে কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়া ইতিমধ্যেই দুর্ঘটনা কমাতে মোটরবাইকের পরিবর্তে সাইকেল ব্যবহারকে উৎসাহিত করছে। কিন্তু বাংলাদেশে মোটরবাইক নিয়ন্ত্রণে কোন আইন প্রয়োগ নেই। বরং বিশেষজ্ঞদের দাবি, সরকারের আর্থিক নীতিতে এই দুই চাকার যানবাহনের ব্যাপক প্রচার করা হচ্ছে।সড়কে মোটরসাইকেলের আধিক্যের কারণে দুর্ঘটনার সংখ্যাও বাড়ছে।

আরএসএফ -এর ২০২১ রিপোর্ট অনুযায়ী, মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় হতাহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত দুই বছরে দুর্ঘটনা দ্বিগুণ হয়েছে। ২০২১ সালে, ২,২১৪ জন ২,০৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে, যা মোট নিহতের ৩৫.২৩% এবং সমস্ত সড়ক দুর্ঘটনার ৩৮.৬৮%। কিন্তু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা ২০২০ সালে ১,৪৬২ এবং ২০১৯ সালে ৯৪৫ জন।মোটরবাইক দুর্ঘটনার সংখ্যা ২০১৯ সালে ছিল মাত্র ১,১৮৯টি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, চার চাকার যানবাহনের তুলনায় দুই চাকার যানবাহন ৩০ গুণ বেশি দুর্ঘটনা প্রবণ। এছাড়া বিশৃঙ্খল যানজটের কারণেও দুর্ঘটনার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। টু-হুইলারগুলি ভারসাম্য ও নিয়ন্ত্রণহীন। ফলে গাড়িগুলো চালানোর সময় চালকেরা ভারসাম্য রক্ষা করতে পারেনা। স্পিড ব্রেকার এবং ছোট গর্তও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এই সব রাইডারের চালকরা বয়সে তরুণ। ফলে খুব নিয়ন্ত্রণহীনভাবে গাড়ী চালনায় তারা অভ্যস্থ। দুর্ঘটনায় পতিত হলে এইসব হালকা গাড়ীর চালক ও আরোহী পাশ দিয়ে চলতে থাকা বড় গাড়ীর চাপায়ও অনেক সময় মারা যায়।

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)-এর তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৩৫,০০,০০০ এর বেশি। এর মধ্যে প্রায় ৯,০০,০০০ নিবন্ধিত মোটরসাইকেল শুধু ঢাকা শহরেই চলে। অনেক দেশে, নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশের কথা ভেবেও দূষণ রোধ করার জন্য মোটরবাইকের পরিবর্তে অযান্ত্রিক সাইকেল ব্যবহারে উৎসাহিত করা হয়। কারণ দ্বি-চাকার গাড়ির শব্দ দূষণের একটি প্রধান উৎস। ঢাকা শহর শব্দ দূষণের দিক থেকে পৃথিবীর বড় শহরগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে। এসব বিবেচনা করে আমাদের দেশের জনসাধারণকেও বিশেষ করে ঢাকায় বসবাসকারী জনগণকে অযান্ত্রিক সাইকেল ব্যবহারে উৎসাহিত করা যেতে পারে।

দেশে সড়কে দুর্ঘটনার শিকার বেশিরভাগ মানুষই উপার্জনক্ষম এবং অনেকেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। সড়ক দুর্ঘটনার কারণে তাই দেশের অর্থনীতিতে বিশাল প্রভাব পড়ছে। এআরআই আমাদের দেশে দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত মানুষের সংখ্যা ও দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতদের ওপর নির্ভরশীল মানুষের ক্ষতির হিসাব তৈরি করেছে। ওই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিগত তিন বছরে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে দেশে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ৯০ কোটি টাকা।

এআরআই-এর পরিচালক মোঃ হাদিউজ্জামান তার তথ্যানুন্ধানে উল্লেখ করেছেন, দেশে বছরে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে যে পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়, দুর্ঘটনার ৭০% কমানো গেলে ঐ পরিমাণ ক্ষতির টাকা দিয়ে একটি পদ্মাসেতু তৈরি করা যেতো। এআরআই গবেষণা ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত দুই বছর মহামারীর কারণে যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা ছিল। প্রায় ১৫০ দিন সড়কে যান চলাচল বন্ধ ছিল। যদি এই দুইবছর যান চলাচল করতো, সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি আরো বেশী হতো।

সড়ক দুর্ঘটনায় হত্যার জন্য দায়ীদের বাংলাদেশের আইনে খুব কমই শাস্তি দেওয়া হয়। বীমা ব্যবস্থা না থাকায় একটি পরিবারকে ধ্বংস করার জন্য একটি সড়ক দুর্ঘটনাই যথেষ্ট। আগের মোটরযান আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় একজন সদস্য হারালে পরিবারের জন্য ২০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণের বিধান ছিল। সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য একটি তহবিল গঠনের বিধান অন্তর্ভুক্ত করে সরকার ২০১৯ সালে নতুন সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়ন করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করে কোনো তহবিল গঠন করা হয়নি।

বিআরটিএ ২০২০ সালে সড়ক পরিবহন আইনের খসড়া প্রণয়ন করে তহবিলের বিশদ বিবরণ তুলে ধরে। সরকার এখনো খসড়া অনুমোদন করেনি।খসড়া আইনে বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তি ৩ লাখ টাকা এবং সডক দুর্ঘটনায় সদস্য হারানো প্রতিটি পরিবার ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন। তহবিলের জন্য অর্থ সরকারী কোষাগার, যানবাহন মালিকদের ফি, সড়ক পরিবহন আইনে আদায় করা বিভিন্ন জরিমানা, যানবাহন মালিক ও পরিবহন শ্রমিক সমিতির কাছ থেকে ও যেকোনো আইনি উৎস থেকে আসবে।

বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল ও বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী, দেশে সডক দুর্ঘটনার প্রধান কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে চালকদের বেপরোয়া চালানো, অতিরিক্ত গতি, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন ও অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট। এগুলো ছাড়া চালকদের কোনো নির্দিষ্ট বেতন ও কর্মঘণ্টা না থাকা, মহাসড়কে কম গতির যানবাহন চলাচল, বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালানোর প্রবণতা, ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এবং গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজিও সড়ক দুর্ঘটনার অন্যান্য কারণ।

গত ১২ বছরে জাতীয় বাজেটে সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নে বরাদ্দ বেড়েছে। নতুন রাস্তা তৈরি হয়েছে, পুরনো রাস্তাগুলো প্রশস্ত করা হয়েছে। সড়ক নিরাপত্তায় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে নতুন সড়ক পরিবহন আইন পাস করেছে সরকার। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এতো উদ্যোগ গ্রহনেও সড়কে মৃত্যু কমছে না।

শুধু আইন প্রণয়ন সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে খুব একটা সহায়ক হবে না। এর কঠোর বাস্তবায়নের পাশাপাশি সচেতনতা তৈরি করতে হবে। উন্নত দেশগুলোকে অনুসরণ করে ট্রাফিক আইন ও ব্যবস্থাপনা উভয়কেই আধুনিকীকরণ করতে হবে। বিআরটিএকে অবশ্যই তার দায়িত্ব শতভাগ সততার সাথে পালন করতে হবে কারণ এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কোন জীবনের মূল্য ২০,০০০ টাকা বা ৫,০০,০০০ টাকা হতে পারে না। একটি ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এই মুল্য হবে অনেক বেশি। তাই সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য একটি ভাল ক্ষতিপূরণের বন্দোবস্ত করা উচিত কারণ, প্রতিটি সড়ক দুর্ঘটনার পেছনেই কোন না কোনভাবে রাষ্ট্রের দায় থাকে। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে না পারলে আমরা অর্থনৈতিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হব কারণ এতে শুধু জীবননাশই হয় না বরং, মানবসম্পদেরও বিনাশ হয়। অনেকেই দুর্ঘটনায় আহত হয়ে উৎপাদনশীল কাজে অক্ষম হয়ে পড়ে।

আমরা আশা করি, সরকার সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে। কারণ, সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশ একটি সত্যিকারের দানব হয়েছে উঠেছে। আমাদের দেশের রাস্তায় আর একটি জীবনও নষ্ট হবে না – এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখকঃ মিয়া মনসফ, যুগ্ম-সম্পাদক, এমএনএ

x

Check Also

শের-ই-বাংলা

বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হকের ৬২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

এমএনএ ফিচার ডেস্কঃ বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হকের ৬২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। শেরে ...