Don't Miss
Home / ইসলাম ও জীবন / জীবন চরিত / নবী-রাসুল / মহানবী (সা.) এর শৈশব ও কৈশোরকাল

মহানবী (সা.) এর শৈশব ও কৈশোরকাল

এমএনএ ফিচার ডেস্ক : মানবতার কল্যাণকামী মানুষের বিভিন্ন শ্রেণি রয়েছে। তার মধ্যে সর্বাধিক উত্তম কল্যাণকামী মানুষেরা হচ্ছেন আল্লাহতায়ালার প্রেরিত নবী রাসুলগণ। তাদের মধ্যেও মানবতার মুক্তির দূত হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বোচ্চ আসনে সমাসীন। মহানবী (সা.) -এর জীবনাদর্শ কালোত্তীর্ণ, শাশ্বত এবং সর্বোত্তম।

সমাজ, সামাজিক বাস্তবতা, পারিবারিক জীবনযাপন পদ্ধতি, সামাজিক সম্পর্ক, অর্থনৈতিক লেনদেন ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড- সব ক্ষেত্রেই নবী করীমের (সা.) পদচারণা ছিল অনুকরণীয়।

তাই মহানবী (সা.) হচ্ছেন বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারি। তার জীবনের প্রতিটি পর্যায় মানবতার জন্য আলোকবর্তিকা। জন্ম থেকে শৈশব, কৈশোর থেকে যৌবন- জীবনের যে কোনো স্তরে তিনি ছিলেন আদর্শের ধারক। শুধু নবুয়তি জীবনই নয়, নবুয়তপূর্ব জীবনে রাসুল (সা.) আদর্শের যে নমুনা স্থাপন করেছেন, তা কেয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য, সত্য ধারণে উর্বর হৃদয়ের জন্য অদ্বিতীয় আলোর উৎস হয়ে থাকবে।

রাসুলে করীমের (সা.) জন্মের আগে এমন কিছু ঘটনা প্রকাশ পেয়েছিল যা দ্বারা বিশ্ববাসী বুঝতে পেরেছিল যে, পৃথিবীতে এমন এক মহামানবের আবির্ভাব হতে যাচ্ছে, যিনি হবেন অনুপম চরিত্রের অধিকারি ও আলোর দিশারি। যেমন মা আমিনা (রা.) বলেছেন, যখন তিনি জন্মগ্রহণ করেন, তখন দেহ থেকে একটি আলো বের হলো। সেই আলোয় শাম দেশের মহল উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

প্রসিদ্ধ সিরাত গ্রন্থ আর-রাহিকুল মাখতুম পৃষ্ঠা ৭১-এ এসেছে, নবী করিম (সা.) জন্ম গ্রহণের সময় কেসরার রাজপ্রাসাদের ১৪টি স্তম্ভ ধসে পড়েছিল। অগ্নি উপাসকদের অগ্নিকুণ্ড নিভে গিয়েছিল। বহিরার গির্জা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

মা হালিমা (রা.) বলেন, আমি শিশু মুহাম্মদকে (সা.) ঘরে আনার পর আমার সব অভাব দূরীভূত হয়ে গেল, আমার উভয় স্তন দুধে পূর্ণ হয়ে গেল ও উটনীর স্তনগুলো দুধে ভরে গেল। আমাদের দুর্বল গাধাটি দ্রুত গতিসম্পন্ন হয়ে গেল। বকরিগুলো চারণভূমি থেকে ভরা পেটে ও ভরা স্তনে ফিরে আসতে লাগলো। এভাবেই শিশু মুহাম্মদের (সা.) মহিমা এক এক করে প্রকাশ হতে থাকল। (সিরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃষ্টা ১৬২)

তৎকালীন আরবের রীতি ছিল যে তারা মরুভূমির মুক্ত আবহাওয়ায় বেড়ে উঠার মাধ্যমে সন্তানদের সুস্থ দেহ এবং সুঠাম গড়ন তৈরির জন্য জন্মের পরপরই দুধ পান করানোর কাজে নিয়োজিত বেদুইন মহিলাদের কাছে দিয়ে দিতেন এবং নির্দিষ্ট সময় পর আবার ফেরত নিতেন। এই রীতি অনুসারে মোহাম্মদকেও হালিমা বিনতে আবু জুয়াইবের (অপর নাম হালিমা সাদিয়া) হাতে দিয়ে দেয়া হয়।

শিশু মুহাম্মাদ (সা.) যখন হালিমার স্তন্য পান করতেন, তখন মাত্র একটি স্তন্যই পান করতেন। অপর স্তনটি তার দুধভাই হালিমার আপন শিশুপুত্রের জন্য রেখে দিতেন। অবুঝ শিশুর অধিকার প্রদানের এমন ঘটনা পৃথিবীতে বিরল। শিশু মুহাম্মদ প্রথম কথা শুরু করেছিলেন এ বাক্যটি দিয়ে, আল্লাহু আকবার কাবীরা ওয়া ছুবহানাল্লাহি কাছীরা। অর্থাৎ আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আর সর্বাধিক পবিত্রতা আল্লাহর জন্য।

দুই বছর লালনপালনের পর হালিমা শিশু মোহাম্মদকে আমিনার কাছে ফিরিয়ে দেন। কিন্তু এর পরপরই মক্কায় মহামারী দেখা দেয় এবং শিশু মুহাম্মাদকে হালিমার কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। হালিমাও চাচ্ছিলেন শিশুটিকে ফিরে পেতে। এতে তার আশা পূর্ণ হল।

ইসলামী বিশ্বাসমতে এর কয়েকদিন পরই একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটে – একদিন শিশু নবীর বুক চিরে কলিজার একটি অংশ বের করে তা জমজম কূপের পানিতে ধুয়ে আবার যথাস্থানে স্থাপন করে দেয়া হয়। এই ঘটনাটি ইসলামের ইতিহাসে সিনা চাকের ঘটনা হিসেবে খ্যাত।

এই ঘটনার পরই হালিমা মুহাম্মাদকে মা আমিনার কাছে ফিরিয়ে দেন। ছয় বছর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত তিনি মায়ের সাথে কাটান। এই সময় একদিন আমিনার ইচ্ছা হয় ছেলেকে নিয়ে মদীনায় যাবেন। সম্ভবত কোন আত্মীয়ের সাথে দেখা করা এবং স্বামীর কবর জিয়ারত করাই এর কারণ ছিল।

আমিনা ছেলে, শ্বশুর এবং দাসী উম্মে আয়মনকে নিয়ে ৫০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মদীনায় পৌঁছেন। তিনি মদীনায় একমাস সময় অতিবাহিত করেন। একমাস পর মক্কায় ফেরার পথে আরওয়া নামক স্থানে এসে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।

মাতার মৃত্যুর পর দাদা আবদুল মোত্তালেব শিশু মুহাম্মাদকে নিয়ে মক্কায় পৌঁছেন। এর পর থেকে দাদাই মুহাম্মাদের দেখাশোনা করতে থাকেন। মোহাম্মদের বয়স যখন ৮ বছর ২ মাস ১০ দিন তখন তার দাদাও মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি তার পুত্র আবু তালিবকে মোহাম্মদের দায়িত্ব দিয়ে যান।

আবু তালিব ব্যবসায়ী ছিলেন এবং আরবদের নিয়ম অনুযায়ী বছরে একবার সিরিয়া সফরে যেতেন। মুহাম্মাদের বয়স যখন ১২ বছর তখন তিনি চাচার সাথে সিরিয়া যাওয়ার জন্য বায়না ধরলেন। প্রগাঢ় মমতার কারণে আবু তালিব আর নিষেধ করতে পারলেননা। যাত্রাপথে বসরা পৌঁছার পর কাফেলাসহ আবু তালিব তাঁবু ফেললেন। সে সময় আরব উপদ্বীপের রোম অধিকৃত রাজ্যের রাজধানী বসরা অনেক দিক দিয়ে সেরা ছিল।

কথিত আছে, শহরটিতে জারজিস সামে এক খ্রিস্টান পাদ্রী ছিলেন যিনি বুহাইরা বা বহিরা নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি তার গীর্জা হতে বাইরে এসে কাফেলার মুসাফিরদের মেহমানদারী করেন। এ সময় তিনি বালক মুহাম্মাদকে দেখে শেষ নবী হিসেবে চিহ্নিত করেন।

ফুজ্জারের যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন নবীর বয়স ১৫ বছর। এই যুদ্ধে তিনি স্বয়ং অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের নির্মমতায় তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হন। কিন্তু তাঁর কিছু করার ছিলনা। সে সময় থেকেই তিনি কিছু একটি করার চিন্তাভাবনা শুরু করেন।

রাসুল (সা.) শিশুকাল থেকেই অত্যন্ত লাজুক ছিলেন। তাঁর লজ্জাশীলতা সম্পর্কে একটি ঘটনা হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, কাবাঘর নির্মাণকালে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর চাচা হযরত আব্বাস (রা.) পাথর ভাঙছিলেন।

আব্বাস (রা.) রসুলুল্লাহকে (সা.) বললেন- তহবন্দ (কোমর থেকে নিচের অংশের বস্ত্র বিশেষ) খুলে কাঁধে বাঁধো, ধূলাবালি থেকে রক্ষা পাবে। তহবন্দ খোলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন এবং আকাশের দিকে তাকালেন ও হুঁশ হারিয়ে ফেললেন। খানিক পরেই হুঁশ ফিরে এলে বললেন, আমার তহবন্দ? এরপর তাকে তহবন্দ পরিয়ে দেয়া হয়।

সা’দ বংশের লোকেরা সে যুগে বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল আরবি ভাষায় কথাবার্তা বলার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিতে শিশু মুহাম্মদের (সা.) লালন-পালনের দায়িত্ব গিয়ে পড়ল এই মার্জিত ও উন্নত রুচিবোধ সম্পন্ন সা’দ বংশের ওপর, যার কারণে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুকাল থেকেই কথাবার্তায় মিষ্ট ও লালিত্যপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করতেন। শিশুকালেই আরবের মানুষেরা তাঁর মাধ্যমে কল্যাণ লাভ করতে থাকেন।

আরবে দীর্ঘ অনাবৃষ্টির কারণে দুর্ভিক্ষ চলছিল। কোরায়েশরা বৃষ্টির জন্য দোয়া করতে আবু তালিবের কাছে আবেদন জানালেন। আবু তালিব একটি বালক সঙ্গে নিয়ে বের হলেন এবং কাবা ঘরের সামনে গিয়ে দোয়া করলেন। বালক তার হাতে আঙুল রাখলে সঙ্গে সঙ্গে আকাশে মেঘ এলো ও মুষলধারে বর্ষণ হলো। মৃত জমিন সজীব ও উর্বর হয়ে উঠল। আর সেই শিশুটি ছিল মুহাম্মদ (সা.)।

শৈশব থেকেই রাসুল (সা.) ছিলেন পরম সত্যবাদী। তিনি কখনো সত্য থেকে বিচ্যুত হননি। তিনি ছিলেন সবার চেয়ে অধিক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন উন্নত চরিত্রের অধিকারি। সবার প্রিয় ও সম্মানিত প্রতিবেশী, পরম সত্যবাদী, সর্বাধিক পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হৃদয়ের অধিকারী।