মোহাম্মদী নিউজ এজেন্সী (এমএনএ) : আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস বা ভ্যালেন্টাইন ডে। তবে তরুণ-তরুণী শুধু নয়, নানা বয়সের মানুষের ভালোবাসার বহুমাত্রিক রূপ প্রকাশের আনুষ্ঠানিক দিন আজ। এ ভালোবাসা যেমন মা-বাবার প্রতি সন্তানের, তেমনি মানুষে-মানুষে ভালোবাসাবাসির দিনও এটি।
ঋতুরাজ বসন্তের দ্বিতীয় দিনে ভালবাসা দিবসে বাঙালি মনের ভালোবাসাও আজ হয় পবিত্র। ফুলে রাঙা আর বাসন্তী মোহে মুগ্ধ। এজন্যই বোধ হয় কবিতায় বলা হয়, ‘’হৃদয়ে লিখেছিনু তোমায়; বসন্তে তুমি আরও স্নিগ্ধ, আহা আরও উচ্ছল তুমি- ভালোবাসা।”
আজকের ভালোবাসা শুধু প্রেমিক-প্রেমিকার নয়- শুধু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই নয়, তা প্রসারিত হবে বন্ধু-বান্ধব, পরিচিতজনসহ সবার মাঝে। এই ভালোবাসা বয়সের ফ্রেমে বাঁধা নয়। কিংবা শুধু তরুণ মনেই এর সীমাবদ্ধতা নয়। আজকের দিনে সব বয়সের, সব মানুষের মনে নতুন দোলা জাগবে।
‘কিন্তু শুধু একটি দিন ভালোবাসার জন্য কেন?’ এ প্রশ্নে কবি নির্মলেন্দ গুণের ছোট জবাব, ‘ভালোবাসা একটি বিশেষ দিনের জন্য নয়। সারাবছর, সারাদিন ভালোবাসার। তবে আজকের এ দিনটি ভালোবাসা দিবস হিসেবে বেছে নিয়েছে মানুষ।’
বসন্তের আগুনরাঙা শিমুল-পলাশ ভালোবাসাকে সত্যিই রাঙিয়ে দেবে। যুগলদের মনের উচ্ছ্বাসকে বাড়িয়ে দেবে সহস্র গুণ। সুললিত করবে প্রেমের বাণী বন্দনাগুলোকে। গাছ থেকে ফুল ঝরার মতো যুগলদের মনের কোণে ঝরবে কথকতা। কত গান। প্রেমের কত কবিতা। বলবে সবাই, ভালোবাসা ক্ষণিকের নয়। ভালোবাসা চিরন্তন, বিশ্বাসে। ভালোবাসি তোমায়।
যুগে যুগে, কালে কালে ভালোবাসার টানে আকুল হয়েছে মানব-মানবী। অনাদিকাল থেকে হৃদয়ের প্রগাঢ় আকাঙ্ক্ষা আর মমতা দিয়ে পরস্পরকে কাছে টেনেছে তারা। ভালবাসা নিয়ে লেখা হয়েছে অসংখ্য কালজয়ী কবিতা, গান, উপন্যাস, গল্প, নাটক, সিনেমা। কিন্তু তার আবেদন ফুরায়নি।
মনের যত বাসনা, অব্যক্ত কথা ডালাপালা মেলে ছড়িয়ে পড়বে বসন্তের মধুর হাওয়ায়। মনে লাগবে দোলা, ভালোবাসার রঙে রঙিন হবে হৃদয়। ‘হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল’ হয়ে প্রহর কেটেছে যেসব প্রেমপিয়াসির, তাদের মনের না-বলা কথা প্রস্ফুটিত হবে।
‘যত গোপনে ভালোবাসি পরাণ ভরি/পরাণ ভরি উঠে শোভাতে/যেমন কালো মেঘে অরুণ-আলো লেগে/মাধুরী উঠে জেগে প্রভাতে।’ প্রেমাবেগের তুমুল উচ্ছ্বাস বইয়ে দিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এভাবেই লিখেছেন ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থে। গোপন গহিন ভালোবাসা প্রকাশের সেইদিন আজ।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় ‘আমার জীবনে তুমি বাঁচো ওগো বাঁচো/ তোমার কামনা আমার চিত্ত দিয়ে যাঁচো…’ অথবা ‘তোমরা যে বল ভালবাসা ভালবাসা/সখী ভালবাসা কারে কয়…’। কবির বাঁচা মরার এবং চিত্র দিয়ে ভালবাসা বোঝাবোঝির চিরন্তন বোধ আজ হয়তো একটু বেশিই অনুভূত হবে গোলাপ বিনিময় ও শরীরী ভাষায়। বসন্ত বাতাসে হৃদয়ের মিথস্ক্রিয়ায় সারা বিশ্বের প্রেমপিয়াসী যুগলরা বছরের এ দিনটিকেই বেছে নেবে মনের গহিনের কথকতার কলি ফোটাতে।
চন্ডিদাসের অনাদিকালের সেই সুর-‘দুহঁ করে দুহঁ কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া/আধতিল না দেখিলে যায় যে মরিয়া/ সখী কেমনে বাধিঁব হিয়া…’। এ আবেদনও বাজবে কাল কারও কারও হৃদয়ে। এ দিনেই প্রেমদেব কিউপিড প্রেমশর বাগিয়ে হৃদয়ে কন্দরে ঘুরে বেড়াবেন। সে অনুরাগেই প্রেমপাগল প্রেমিক-প্রেমিকারা পরাণ তাড়িত হয়ে বিদ্ধ হবে দেবতার বাঁকা ইশারায়। তাঁদের মনে লাগবে দোলা, ভালোবাসার রঙে রাঙাবে হৃদয়।
ভালোবাসা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, শুধুমাত্র অনুভূতি দিয়ে প্রকাশ করতে হয়। এটি একটি মানবিক অনুভূতি ও আবেগকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতা। এর রং-রূপ-গন্ধ কিছুই নেই আছে শুধু অনুভূতি। বিশেষ কোন মানুষের জন্য ভালোবাসা স্নেহের শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়তো এমন মুহুর্তকেই স্মরণ করে লিখেছিলেন, “দোহাই তোদের, এতটুকু চুপ কর/ভালোবাসিবারে, দে মোরে অবসর।” জীবজগতের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক হল ভালোবাসা। যার শক্তিতে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত জয় করা যায়। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি উচ্চরিত শব্দগুলোর মধ্যে একটি হলো ‘ভালোবাসা’।
ভালোবাসা উৎসবে মুখর হবে জনপদ। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও আজ পালিত হচ্ছে দিবসটি। প্রযুক্তির কল্যাণে হাইটেক ডিজিটালের যুগে মুঠোফোনের ক্ষুদ্র বার্তা, ই-মেইল অথবা ফেসবুকে পুঞ্জ পুঞ্জ প্রেমকথার কিশলয় পল্লবিত হচ্ছে আজ রাত ১২টার পর থেকেই।
তারুণ্যের অনাবিল আনন্দ আর বিশুদ্ধ উচ্ছ্বাসে সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশের তরুণ-তরুণীদের মাঝেও ভালোবাসা দিবস পালিত হচ্ছে। ভালোবাসার উৎসবে মুখর আজ রাজধানী। এ উৎসবের ছোঁয়া লাগবে গ্রাম-বাংলার জনজীবনেও। অনেকের মতে, ফেব্রুয়ারির এ সময়ে পাখিরা তাদের জুটি খুঁজে বাসা বাঁধে। নিরাভরণ বৃক্ষে কচি কিশলয় জেগে ওঠে। তীব্র সৌরভ ছড়িয়ে ফুল সৌন্দর্যবিভায়। পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে রবীন্দ্র সরোবর পর্যন্ত রাজধানী ঢাকার আনাচে কানাচে এমনকি সারাদেশের পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো সরব হচ্ছে প্রেমিক-প্রেমিকাদের পদচারণায়। হয়তো কবির ভাষায় একে অন্যকে বলবে- ‘তোমাকে ভালোবাসি আমি। ভালোবেসে সখী নিভৃত যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে…’। পশ্চিমা দুনিয়ায় ভ্যালেন্টাইন ডে বা প্রেম উৎসব তারুণ্যের মাঝে এক অদেখা ভুবনের উত্তেজনা ছড়ায়।
এদিনে চকোলেট, পার্ফিউম, গ্রিটিংস কার্ড, ই-মেইল, মোবাইলের এসএমএসে প্রেমবার্তা, হিরার আংটি, প্রিয় পোশাক, খেলনা মার্জার, বইয়ের ভেতরে রাখা গোলাপের ইশারা বিনিময়, আর জড়াজড়ি করা হয়ে উঠবে তরুণ-তরুণীদের প্রথম অনুসঙ্গ। হয়তো আরও থাকবে নীল খামে হালকা লিপস্টিকের দাগ, একটি গোলাপ ফুল, ছোট্ট কোন উপহার, আর ছোট্ট একটি চিরকুট। তাতে দু’ছত্র গদ্য বা পদ্যে প্রেমের ঊর্মি-‘ইউ স্টেপ ইনটু মাই হার্ট, টার্নিং ইট ফ্রম স্টোন…’ অথবা ‘তুমি আমার সবটুকু গান/ঝড়ের পরে একটু চুমু/তাতে আছে সবটুকু প্রাণ…’।
আমাদের দেশে ১৯৯৪ সাল থেকে দিবসটি বেশ ঘটা করে পালিত হয়ে আসছে। এদিন শুধু প্রেম বিনিময় নয়, প্রেমিক প্রেমিকাদের মধ্যে গোপণে বিয়ের হিড়িকও পড়ে। রাজধানীর উদ্যান, বইমেলা, কফিশপ, ফাস্টফুড শপ, লং ড্রাইভ, অথবা নির্জন গৃহকোণে একান্ত নিভৃতে কাটান প্রেমকাতুর তরুণ-তরুণীরা।দিনটি যে শুধু তরুণ-তরুণীদের তা নয়, পিতামাতা-সন্তানদের ভালোবাসাও বড়মাত্রায় উদ্ভাসিত করে। যাঁরা একটু বিজ্ঞ তাঁরা বলেন, প্রেমের কোন দিন থাকে না, ভালোবাসলেই ভ্যালেন্টাইন, সেলিব্রেট করলেই ভ্যালেন্টাইন ডে।
ভালোবাসা দিবস কবে থেকে, কিভাবে শুরু হয়েছে- ইতিহাসের পাতায় তা নিয়ে রয়েছে নানা কাহিনী। ইতিহাসবিদদের মতে, দুটি প্রাচীন রোমান প্রথা থেকে এ উৎসবের সূত্রপাত। এক খ্রিস্টান পাদ্রী ও চিকিৎসক ফাদার সেন্ট ভ্যালেনটাইনের নামানুসারে দিনটির নাম ‘ভ্যালেনটাইনস ডে’ করা হয়। ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি খ্রিস্টানবিরোধী রোমান সম্রাট গথিকাস আহত সেনাদের চিকিৎসার অপরাধে সেন্ট ভ্যালেনটাইনকে মৃত্যুদন্ড দেন। মৃত্যুর আগে ফাদার ভ্যালেনটাইন তার আদরের একমাত্র মেয়েকে একটি ছোট্ট চিঠি লেখেন, যেখানে তিনি নাম সই করেছিলেন ‘ফ্রম ইওর ভ্যালেনটাইন’। সেন্ট ভ্যালেনটাইনের মেয়ে এবং তার প্রেমিক মিলে পরের বছর থেকে বাবার মৃত্যুর দিনটিকে ভ্যালেনটাইনস ডে হিসেবে পালন করা শুরু করেন। যুদ্ধে আহত মানুষকে সেবার অপরাধে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত সেন্ট ভ্যালেনটাইনকে ভালোবেসে দিনটি বিশেষভাবে পালন করার রীতি ক্রমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
ভ্যালেনটাইনস ডে সর্বজনীন হয়ে ওঠে আরো পরে প্রায় ৪০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। দিনটি বিশেষভাবে গুরুত্ব পাওয়ার পেছনে রয়েছে আরো একটি কারণ। সেন্ট ভ্যালেনটাইনের মৃত্যুর আগে প্রতি বছর রোমানরা ১৪ ফেব্রুয়ারি পালন করত ‘জুনো’ উৎসব। রোমান পুরানের বিয়ে ও সন্তানের দেবী জুনোর নামানুসারে এর নামকরণ। এ দিন অবিবাহিত তরুণরা কাগজে নাম লিখে লটারির মাধ্যমে তার নাচের সঙ্গীকে বেছে নিত। ৪০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে রোমানরা যখন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীতে পরিণত হয় তখন ‘জুনো’ উৎসব আর সেন্ট ভ্যালেনটাইনের আত্মত্যাগের দিনটিকে একই সূত্রে গেঁথে ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘ভ্যালেনটাইনস ডে’ হিসেবে উদযাপন শুরু হয়। কালক্রমে এটি সমগ্র ইউরোপ এবং ইউরোপ থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
অনেকে মনে করেন, এই সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের নামানুসারেই প্রথম জুলিয়াস ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ হিসেবে ঘোষণা করেন। আরও একজন ভ্যালেন্টাইনের নাম পাওয়া যায় ইতিহাসে। যুদ্ধের জন্য দক্ষ সৈনিক সংগ্রহের জন্য রোমান সম্রাট ক্লডিয়াস যুবকদের বিয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। তবে তরুণ ভ্যালেন্টাইন নিয়ম ভঙ্গ করে প্রেম ও বিয়ে করেন। ফলে তার মৃত্যুদণ্ড হয়
আমাদের দেশে দিনটিকে ঘিরে ঢাকাসহ সারাদেশেই বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। রাজধানীর শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর, বইমেলা চত্বর থেকে শুরু করে এর আশেপাশের এলাকায় থাকছে দিনভর নানা অনুষ্ঠান। আজ সকালে শাহবাগ চত্বর, বেইলি রোডসহ রাজধানীর বিভিন্নস্থানে, রাজপথে ও অডিটরিয়ামে আয়োজন করা হবে বর্ণাঢ্য র্যালি, সূচনা সঙ্গীত, ভালোবাসার স্মৃতিচারণ, কবিতা আবৃত্তি, গান, ভালোবাসার চিঠি পাঠ এবং ভালোবাসার দাবিনামা উপস্থাপনসহ আরও নানা কর্মসূচি। দিবসটি উপলক্ষে রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়াম, ফ্যান্টাসি কিংডম, নর্ন্দন পার্কসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছে। দিবসটি পালনে আজ সকাল ১০টায় শাহবাগের গণজাগরণ চত্বরে অনুষ্ঠিত হবে ভালোবাসার কনসার্ট।
এদিকে, ঢাকা মহানগরীকে আরও পরিচ্ছন্ন ও দৃষ্টিনন্দন করার উদ্দেশ্যে এদিনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন ঘোষণা করেছেন ‘লাভ ফর ঢাকা উৎসব’ প্রচারাভিযান। আর এসব অনুষ্ঠানের কারণে আজ সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত বিজয় সরণি থেকে শাহবাগ পর্যন্ত মহাসড়ক বন্ধ থাকবে।