এমএনএ ফিচার ডেস্ক : আধুনিক বাংলা কবিতার বরপুত্র কবি শামসুর রাহমানের দশম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন।
সৃষ্টি ও মননের দ্যুতিময় উপস্থাপনা তাকে দিয়েছে সমকালীন বাংলা কবিতার প্রধানতম কবির মর্যাদা। কবি হিসেবে দুই বাংলায় সমান জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। তাকে নাগরিক কবিও বলা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর তার লেখা দুটি কবিতা অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পায়। বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকের ৫ বিশিষ্ট কবির পর আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান পুরুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাকে।
শামসুর রাহমানের জন্ম ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর ঢাকার মাহুতটুলিতে, তাঁর নানাবাড়িতে। বাবা মুখলেসুর রহমান চৌধুরী ও মা আমেনা বেগম। অত্যন্ত সংস্কৃতিমনা পরিবারে জন্ম নেওয়া ১৩ ভাই-বোনের মধ্যে কবি ছিলেন চতুর্থ। তার পৈতৃক বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরার পাড়াতলী গ্রামে। মাত্র ২০ বছর বয়সে সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকায় ১৯৪৯ সালে তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। একসময় তিনিই বলেছিলেন যে, কখনো কবিতার মধ্যে রাজনীতি আনবেন না। কিন্তু ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর তিনি আর তাঁর আগে কথায় স্থির থাকতে পারেননি। কারণ তাঁর চেতনাবাদী মন তাঁকে রাজনীতিকে কবিতার বাইরে রাখতে পারেনি।
শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয়। এরপর তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তাঁর কবিতায় সব সময় স্থান পেয়েছিল জীবনবোধ, শৃঙ্খলমুক্ত জীবনাচার, স্বাধীনচেতা মন। সে কারণেই বারবার তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের কথা, আটান্নর আইয়ুববিরোধী কথা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, স্বাধীনতা-পরবর্তী সাড়ে তিন বছর, পঁচাত্তরের নির্মম ঘটনা, পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট, আশির দশকের সামরিক স্বৈরশাসন ইত্যাদি।
‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, ‘আসাদের শার্ট’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’, ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘অভিশাপ দিচ্ছি’, ‘সফেদ পাঞ্জাবি’, ‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা’, ‘ইলেকট্রার গান’, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’, ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’, ‘ধন্য সেই পুরুষ’, ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’, ‘গর্জে ওঠো স্বাধীনতা’ ইত্যাদিই কবিতার মধ্যে বিদ্রোহী চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।। তবে তার মধ্যে ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ ও ‘স্বাধীনতা তুমি’- এ দুটি কবিতা সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য হয়েছে স্বাধীনচেতা বাঙালি পাঠকসমাজে।
১৯৫৭ সালে একজন সংবাদকর্মী হিসেবে ‘দ্য ডেইলি মর্নিং নিউজ’ পত্রিকায় কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। ১৯৫৭ সালে রেডিও পাকিস্তানে অনুষ্ঠান প্রযোজক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত সেখানে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬০ সালে আবার মর্নিং নিউজে ফিরে আসেন এবং ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত মর্নিং নিউজের সহযোগী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালের শেষের দিকে দৈনিক পাকিস্তানে সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন শামসুর রাহমান। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ওই পত্রিকাটি দৈনিক বাংলা নামে প্রকাশিত হয়। ১৯৭৭ সালে ‘দৈনিক বাংলা’ ও ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’র সম্পাদক নিযুক্ত হন তিনি। পরে সামরিক সরকার আমলে স্বৈরাচার এরশাদের সঙ্গে আপস করতে না পেরে তিনি ১৯৮৭ সালে দৈনিক বাংলা থেকে পদত্যাগ করেন। এর পর সাহিত্য পত্রিকা অধুনার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় সম্পাদকীয় ও উপ-সম্পাদকীয় লেখায় নিজের ছদ্মনাম হিসেবে সিন্দাবাদ, চক্ষুষ্মান, লিপিকার, নেপথ্যে, জনান্তিকে, মৈনাক ব্যবহার করেছেন। একজন প্রতিবাদী কবি হিসেবেও পরিচিতি রয়েছে তার। তৎকালীন সরকারি পত্রিকায় কাজ করা সত্ত্বেও তিনি আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের প্রতি বিদ্রুপ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারাভোগের সময় তাকে উদ্দেশ করে তিনি কবিতা লিখেছেন। রবীন্দ্রসংগীতের ওপর পাকিস্তান সরকারের নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তিনি।
১৯৮৭ সালে স্বৈরশাসন আমলে পর পর ৪ বছর ধরে ‘শৃঙ্খল মুক্তির কবিতা’, ‘স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কবিতা,’ ‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা’ এবং ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কবিতা’ লেখেন তিনি। স্বৈরশাসনের পতন হলে তিনি লেখেন ‘গণতন্ত্রের পে কবিতা।’
সাহিত্যে অনন্য অবদানের জন্য তিনি দেশ-বিদেশের অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো হলো- আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক, জীবনানন্দ পুরস্কার, আবুল মনসুর আহমেদ স্মৃতি পুরস্কার, সাংবাদিকতার জন্য মিৎসুবিশি পুরস্কার, স্বাধীনতা পদক ও আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়া ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে কবিকে সম্মানসূচক ডি. লিট উপাধি দেওয়া হয়।
৬৬টি কাব্যগ্রন্থ, চারটি উপন্যাস, অনেক প্রবন্ধ, ছড়া, শিশুতোষ রচনাসহ তাঁর শতাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। শুধু সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচারে নয়, তাঁর রচনাসমগ্র গুণেমানেও অনন্য। এসব রচনার জন্য বাংলাদেশে সর্বপ্রথম তিনিই ঢাকার কল্যাণপুরে তাঁর নিজ বাসায় সস্ত্রীক জঙ্গি-সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছিলেন। পরে দুজনেরই সাহসী প্রতিরোধে সেদিন তাঁরা প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন। কারণ তিনি তাঁর লেখনীর দ্বারা সর্বদাই জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদবিরোধী ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান এ কবি ২০০৬ সালের ১৭ আগস্টে জাতির এ শোকাবহ মাসে সকল ভক্তকুলকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে ৭৬ বছর বয়সে এক প্রকার অকালপ্রয়াণে যান।
জীবদ্দশায় প্রতিটি জন্মদিন পালনে মৃদৃভাষী বক্তব্য দিতেন তিনি সবার জন্য। তবে কবির স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য নরসিংদীর রায়পুরে তাঁর পৈতৃক পরিত্যক্ত পাড়াতলির বাড়িটিতে যে একটি স্মৃতি পাঠাগার ও সংরক্ষণাগার তৈরি করা হয়েছে, সেটা লোকবলের অভাবে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে রয়েছে বলে এলাকাবাসী এবং কবির ভক্তকুলের অভিযোগ রয়েছে। সে জন্য এ বিষয়ে বর্তমান সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের একটু সুদৃষ্টিই এর জন্য যথেষ্ট বলে মনে করেন অনেকে। কারণ তিনি এতদিন বেঁচে থাকলে এখন দেশের জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কলম নিয়ে আবারও সোচ্চার হতেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। সে জন্যই আজ তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণের প্রয়োজন নতুন প্রজন্মের জন্য। আর সেটি করতে পারলেই প্রগতির পথে দেশ আরো একধাপ এগিয়ে যাবে।
মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে জাতীয় কবিতা পরিষদ ও শামসুর রাহমান স্মৃতি পরিষদের পক্ষ থেকে আজ সকাল ১১টায় বনানী কবরস্থানে কবির কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে।
এছাড়াও আজ আলোচনা সভা, গান, আবৃত্তি ও নিবেদিত কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে তাকে স্মরণ করবে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংস্কৃতি সংযোগ। বিকাল ৩টায় কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের সেমিনার কে হবে এ অনুষ্ঠান। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান। সভাপতিত্ব করবেন আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংস্কৃতি সংযোগের সভাপতি ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেন। আলোচক থাকবেন কবি কামাল চৌধুরী, কবি মোহাম্মদ সাদিক, কবি আসাদ মান্নান, বেগম আখতার কামাল, কবি মাহবুবুল হক শাকিল, কবি সোহরাব হোসেন, শামসুর রাহমানের পুত্রবধূ টিয়া রাহমান ও বিটিভির মহাপরিচালক হারুন অর রশীদ। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে শামসুর রাহমান ও নির্মলেন্দু গুণের কবিতা থেকে আবৃত্তি এবং শামসুর রাহমানকে নিবেদিত কবিতা পাঠ ও স্মৃতি অনুভবের পাশাপাশি গান পরিবেশন করবে ব্যান্ড দল চাষার পাল।