বাংলাদেশে করোনা পরিসংখ্যানে ভয়াবহতার আভাস
Posted by: News Desk
April 22, 2020
এমএনএ রিপোর্ট : করোনার সংক্রমণ দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়ছে দেশজুড়ে। কয়েকদিন ধরেই জ্যামিতিক হারে বাড়ছে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা। বাড়ছে মৃত্যুও।
গতকাল মঙ্গলবার নতুন করে আরও ৪৩৪ জনের শরীরে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। একই সঙ্গে গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের। এ নিয়ে গত দেড় মাসে করোনায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৩ হাজার ৩৮২ জনে পৌঁছাল। মোট মৃত্যু ১১০ জনের।
বিশ্বের করোনা জর্জরিত বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতির তুলনা করে যে পরিসংখ্যান সামনে আসে তা রীতিমতো চোখ রাঙাচ্ছে।
চীনের উহান থেকে শুরু হয়ে করোনাভাইরাস বর্তমানে বিশ্বের ২১০টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রত্যেকটি দেশেই দু-একজনের মাধ্যমে সংক্রমণ শুরু হয়েছিল। যা পরে মহামারির রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ প্রথম তিনজনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এরপর থেকে সময়ের সঙ্গে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিনই বেড়ে চলছে। সংক্রমণের ৪৫ দিন পর এসে দেশে আক্রান্তের সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়ে গেছে। মৃত্যু সংখ্যাও ১০০ অতিক্রম করেছে।
একই সময়কাল বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বের আরও ৮টি দেশের সঙ্গে সংক্রমণ পরিস্থিতির তুলনামূলক বিশ্নেষণে দেখা যায়- যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও ভারতের চেয়ে সংক্রমণ শুরুর ৪৫ দিনের মাথায় বাংলাদেশে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি। এই সময়কালে বাংলাদেশের চেয়ে কেবল ইতালি, স্পেন ও ইরানে বেশি মানুষের সংক্রমণ ও মৃত্যু হয়েছে। যদিও দেড় মাস পর থেকেই জার্মানি ছাড়া বাকি দেশগুলোতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়েছে।
এদিকে দেশে করোনা পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা সংক্রমিত হচ্ছে। শুরুতে ঢাকার মিরপুর, টোলারবাগ, বাসাবো এবং ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জ, মাদারীপুরের শিবচর ও গাইবান্ধায় সংক্রমণ দেখা দিয়েছিল। বর্তমানে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের সর্বত্রই করোনা ছড়িয়ে পড়েছে।
গত কয়েকদিন ধরে গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ ও নরসিংদীকে সংক্রমণের নতুন রুট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই তিনটি জেলায় জ্যামিতিক হারে সংক্রমণ বাড়ছে। ইতোমধ্যে ৩৮ জেলা পুরোপুরি এবং ১৭ জেলা আংশিক লকডাউন ঘোষণা করেছে স্থানীয় প্রশাসন। ১৬ এপ্রিল সারাদেশকে করোনার ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করে স্বাস্থ্য বিভাগ। কিন্তু নানা অব্যবস্থাপনায় করোনা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছেই।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, সংক্রমিত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়- ইতালি, স্পেন ও ইরান ছাড়া প্রথম দেড় মাসে অন্য কোনো দেশে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়নি বা অনেক বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু এই সময়কাল বা তার চেয়ে কিছুটা বেশি সময় পরে এসে করোনা সংক্রমণ ওইসব দেশে মহামারি আকার ধারণ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের দিকে তাকালে এমন চিত্রই দেখা যায়। বাংলাদেশও কিন্তু সেই অবস্থার দিকে এগোচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগ যে বার্তা দিচ্ছে, তাতে হয়তো আরও কিছুটা সময় পর সর্বোচ্চ সংক্রমণ শুরু হবে।
আইইডিসিআর মে মাসের শেষ দিকে অথবা জুনের শুরুতে সর্বোচ্চ সংক্রমণের কথা বলছে। সংক্রমণ যে বেশি হচ্ছে, সেটি জানতে হলে তো পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরিধি বাড়াতে হবে। এ জন্য নতুন ল্যাবের পাশাপাশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যেসব ল্যাব রয়েছে সেগুলোকে কাজে লাগাতে হবে।
প্রতিদিন কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ হাজার কিংবা তারও বেশি মানুষের নমুনা পরীক্ষা প্রয়োজন। তাহলেই প্রকৃত চিত্র জানা যাবে। আর প্রকৃত চিত্র জানতে পারলেই এই ভাইরাস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে আমরা সক্ষম হব।
আক্রান্ত দেশগুলোর ৪৫ দিনের পর্যালোচনা : বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণের তথ্যভিত্তিক পর্যালোচনা করছে আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডওমিটারস ডট ইনফো। এই ওয়েবসাইটে থাকা তথ্যউপাত্ত থেকে বিভিন্ন দেশের প্রথম দেড় মাসের অর্থাৎ শুরুর ৪৫ দিনের করোনা পরিস্থিতির একটা পরিস্কার চিত্র পাওয়া যায়।
যুক্তরাষ্ট্র : গত ২১ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়। দেড় মাস পর ৬ মার্চে এই সংখ্যা বেড়ে ৩১৯ জনে দাঁড়ায়। দেশটিতে প্রথম ২৯ ফেব্রুয়ারি একজনের মৃত্যু হয়। দেড় মাসে মৃত্যু সংখ্যা বেড়ে ১৫ জনে দাঁড়ায়।
ইতালি : ইউরোপের এ দেশটিতেই প্রথম করোনাভাইরাস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃত্যুর রেকর্ড হয়েছে সেখানে। গত কয়েকদিন ধরে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও এখনও আক্রান্ত ও মৃত্যুর ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। ইতালিতে প্রথম রোগী শনাক্ত হয় গত ৩১ জানুয়ারি। দেড় মাস পর গত ১৬ মার্চ তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৩ হাজার ৭৩ জনে। দেশটিতে ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। ১৬ মার্চ তা বেড়ে ২ হাজার ১৫৮ জনে দাঁড়ায়।
স্পেন : ইউরোপের আরেক দেশ স্পেনকেও করোনা মাহামারি কাঁদাচ্ছে। ইতালির মতো এই দেশেও প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয় ৩১ জানুয়ারি। দেড় মাস পর ১৬ মার্চ তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৯৪২ জনে। স্পেনে করোনায় প্রথম ৪ মার্চ একজনের মৃত্যু হয়। ১৬ মার্চ তা বেড়ে ৩৪২ জনে দাঁড়ায়।
ফ্রান্স : ইউরোপের মধ্যে ফ্রান্সে কিছুটা আগে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। গত ২৪ জানুয়ারি দেশটিতে প্রথম করোনার সংক্রমণ ধরা পড়ে। দেড় মাস পর ৯ মার্চে তা বেড়ে ১ হাজার ৪১২ জনে পৌঁছায়। দেশটিতে ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। গত ৯ মার্চ তা বেড়ে ৩০ জনে পৌঁছায়।
জার্মানি : করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সফলতা দেখিয়েছে জার্মানি। ইউরোপের অন্যান্য দেশে ভাইরাসটি মহামারি আকার ধারণ করলেও জার্মানি ছিল ব্যতিক্রম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশটিতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে। গত ২৭ জানুয়ারি দেশটিতে প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়। দেড় মাস পর ১২ মার্চ তা বেড়ে ২ হাজার ৭৪৫ জনে পৌঁছায়। জার্মানিতে করোনায় ৯ মার্চ প্রথম দু’জনের মৃত্যু হয়। ১২ মার্চ তা বেড়ে ছয়জন হয়।
যুক্তরাজ্য : শুরুতে নিয়ন্ত্রণে থাকলেও পরে যুক্তরাজ্যে করোনা ভাইরাস মহামারি আকার ধারণ করেছে। দেশটিতে গত ৩১ জানুয়ারি প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়। দেড় মাস পর ১৬ মার্চ তা বেড়ে এক হাজার ৫৪৩ জনে দাঁড়ায়। ৫ মার্চ প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। ১৬ মার্চ মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫৫ জনে পৌঁছায়।
ইরান : ইরানেও করোনা পরিস্থিতি মহামারি আকার ধারণ করেছে। দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার উপদেষ্টাসহ শীর্ষস্থানীয় কয়েকজনের ইতোমধ্যে মৃত্যু হয়েছে। ইরানে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম দু’জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়। দেড় মাস পর ৩ এপ্রিল তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৩ হাজার ১৮৩ জনে। ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম দু’জনের মৃত্যু হয়। ৩ এপ্রিল তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ২৯৪ জনে।
ভারত : প্রতিবেশী ভারতেও করোনা সংক্রমণ চলছে। দেশটিতে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় ৩০ জানুয়ারি। দেড় মাস পর ১৪ মার্চ তা বেড়ে ১০০ জনে পৌঁছায়। ভারতে এই ভাইরাসে প্রথম ১২ মার্চ একজনের মৃত্যু হয়। ১৪ মার্চ মৃতের সংখ্যা বেড়ে দু’জনে পৌঁছায়।
বাংলাদেশ : গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম তিনজনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়। দেড় মাস পর গতকাল মঙ্গলবার ২১ এপ্রিল তা বেড়ে ৩ হাজার ৩৮২ জনে পৌঁছেছে। ১৮ মার্চ প্রথম করোনায় একজনের মৃত্যু হয়। ২১ এপ্রিল পর্যন্ত তা বেড়ে ১১০ জনের পৌঁছাল।
সার্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও ভারতের তুলনায় সংক্রমণের ৪৫ দিনের মাথায় বাংলাদেশে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি। এই সময়ে বাংলাদেশের চেয়ে কেবল ইতালি, স্পেন ও ইরানে বেশি মানুষ আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণ করেছে।
পরিশেষে যে কথা না বললেই নয়, তাহলো করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি বুঝতে হলে নমুনা পরীক্ষা করতে হবে। আমাদের নমুনা পরীক্ষার পরিধি অত্যন্ত অপ্রতুল। এ কারণে কতসংখ্যক মানুষ এই মুহূর্তে সংক্রমিত হয়েছেন, তা আমরা জানতে পারছি না। এটি জানতে হলে পরীক্ষার পরিধি বাড়াতেই হবে। অন্যথায় শনাক্তের বাইরে থাকা সংক্রমিত ব্যক্তির মাধ্যমে ভাইরাসটি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়বে, যার ফল হবে ভয়াবহ।
আভাস পরিসংখ্যানে করোনা ভয়াবহতার বাংলাদেশে 2020-04-22