পিঠার বাহারি কথা
। ফারহানা রুমকি ।
বাঙ্গালি সংস্কৃতিতে পিঠা একটা বড় জায়গা দখল করে আছে। । নতুন ধান ঘরে আসলে গ্রামাঞ্চলে ঘরে ঘরে পিঠা বানায়। শীত কালে পিঠা বানানোর ধুম পড়ে যায় তাছাড়া ইন্টারনেটের ফলে পিঠা বানানোর রেসিপি খুব সহজে পাওয়া যাচ্ছে তাই এখন নারীরা বিকালের নাস্তার জন্য ঝটপট পিঠা বাড়িতেই সাচ্ছন্দে বানিয়ে পরিবেশন করছে। আমার কাছে মনে হয় পরিবারের সবাই মিলে পিঠা একসাথে খেতে বসলে একটা ঐক্যবদ্ধ মনোভাব তৈরী হয়, পারিবারিক বন্ধন আরো সুদৃঢ় হয়।
‘পিঠা’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘পিষ্টক’ শব্দ থেকে আবার পিষ্টক এসেছে ‘পিষ্’ ক্রিয়ামূলে তৈরি হওয়া শব্দ ‘পিষ্ট’ থেকে পিষ্ট অর্থ চূর্ণিত, মর্দিত, দলিত হরিচরণ বন্দোপাধ্যায় বঙ্গীয় শব্দকোষ বইয়ে লিখেছেন, পিঠা হলো চাল গুঁড়া, ডাল বাটা, গুড়, নারিকেল ইত্যাদির মিশ্রণে তৈরি মিষ্টান্ন বিশেষ বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশষ্য ধান, ধান থেকে চাল এবং সেই চালের গুঁড়ো পিঠা তৈরির মূল উপাদান।
ভারত উপমহাদেশীয় সভ্যতার প্রেক্ষাপটে কখন থেকে বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতিতে পিঠা গুরত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, তার কোনো লিখিত বিবরণ নেই। প্রচলিত গল্প, প্রাচীন বইপত্র থেকে এর প্রাচীনত্ব নির্ণয় করা কিছুটা কঠিনই বটে। সংস্কৃত সাহিত্যে ‘পিষ্টক’ শব্দটির উল্লেখ মেলে সেই সূত্রে বলা চলে ভারতীয় উপমহাদেশে পিঠা খাবার প্রচলন অনেক প্রাচীন বাংলাভাষায় লেখা কৃত্তিবাসী রামায়ণ, অন্নদামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, মনসামঙ্গল, চৈতন্যচরিতামৃত ইত্যাদি কাব্য এবং ময়মনসিংহ গীতিকার কাজল রেখা আখ্যানের সূত্র ধরে গত আনুমানিক পাঁচশ’ বছর সময়কালে বাঙালি খাদ্যসংস্কৃতিতে পিঠার জনপ্রিয়তার কথা উল্লেখ করা যায়। যেহেতু প্রাচীন বইপুস্তকে পিঠার কথা এসেছে, তাই ধরে নেওয়া যায়, পিঠা খাবার প্রচলন বাঙালি সমাজেও অনেক প্রাচীন।বিশাল উপমহাদেশে বসবাস করা বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যেও পিঠা যে জনপ্রিয় খাবার সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশে, এই একুশ শতকের শহুরে জীবনে সারা বছরই প্রায় পিঠা খাওয়া হয় দোকান থেকে কিনে। কৃষিসংস্কৃতির সাথে গ্রামীণ মানুষের প্রত্যক্ষ যোগাযোগই এর কারণ। অগ্রহায়ণ মাসে নতুন ধান উঠে যাবার পর সেগুলো গোলাবন্দি করতে বেশ কিছুটা সময় লেগে যায়। এই কর্মব্যস্ত সময়ে গ্রামীণ মানুষের ‘শখ’ করার সময় থাকে না। নবান্ন করার পর ধীরেসুস্থে জাঁকিয়ে শীত পড়লে পৌষের সংক্রান্তিতে পিঠা তৈরির আয়োজন করা হয়। নতুন ধান থেকে তৈরি চালে যে সুঘ্রাণ আর আর্দ্রতা থাকে, পিঠা বানানোর আটা তৈরিতে সেই চাল উপযোগি। আগে নতুন ধান উঠে গেলে নারীরা ঢেঁকিতে পিঠার জন্য চালের আটা বানাতো। আর এখন মেশিনে একনিমেশেই অনেক চাল আটা করা যায়।
পিঠার দেশ বাংলাদেশ। পিঠা বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। তবে অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন পিঠা যেমন দেখা যায়, তেমনি একেকটি পিঠার বিভিন্ন নামও লক্ষ করা যায়।
শীতকাল-কেই পিঠার মৌসুম বলা চলে। কারণ, এ সময়ে খেজুরের রস পাওয়া যায়। এসময়ই বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে পিঠা তৈরি হয়। পুরো বাংলাদেশে জনপ্রিয় কিছু পিঠার কথা আমরা বলতে পারি এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, তেলের পিঠা, পুলি পিঠা, ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, দুধ পিঠা, রসের পিঠা, নকশি পিঠা ইত্যাদি।
আমরা ‘পিঠাপুলি’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করি মূলত পুর ছাড়া এবং পুর দেওয়া পিঠাকে একসাথে বোঝাতে ‘পিঠাপুলির আয়োজন’ বলতে আমরা বুঝি, এই আয়োজনে যেমন চিতই পিঠা, তেলের পিঠা, নকশি পিঠা, দুধে বা রসে ভেজানো পিঠা থাকবে, তেমনি নারকেল বা অন্যান্য জিনিসপত্রের পুর দেওয়া ভাজা বা ভাপা পুলিও থাকবে। জানিয়ে রাখি, মূলত পাটিসাপটা পিঠাও উৎসগতভাবে পুলিপিঠার অন্তর্গত। এটাও জানিয়ে রাখি, একমাত্র ভাপা পিঠা বা ধুকি/ ধুপি পিঠা ছাড়া যে-কোনো ধরনের ভাজা বা ভাপা পিঠাকে দুধে বা রসে ভেজানো যায়।
আদিতে পিঠা মিষ্টি খাবার হিসেবেই খাওয়া হতো। এখনো বাংলাদেশের বেশিরভাগ পিঠা মিষ্টি জাতীয় এবং গুড়সহযোগে খাওয়া হলেও কখনো কখনো ঝাল পিঠা খাওয়ারও প্রচলন রয়েছে। যেমনঃ চিতই পিঠা সরিষা বাটা কিংবা মরিচের ভর্তা বা শুটকির ঝাল ঝাল ভর্তা দিয়েও খাওয়া হয়। আবার ছিটা পিঠার আটায় মরিচ বাটা মিশিয়ে ঝাল করে ভাজা হয়। ছিটা পিঠা আবার হাঁসের মাংস দিয়েও খাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে। বেশিরভাগ পিঠা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খাওয়া হলেও কিছু পিঠা আছে আঞ্চলিক, যেগুলো নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাইরে তেমন একটা খাওয়া হয় না যেমনঃ সিলেটের চুঙ্গি পিঠা, বিক্রমপুরের বিবিখানা পিঠা ইত্যাদি। উপরের পিঠাগুলো ছাড়াও, তালের পিঠা, কলা পিঠা, নকশি পিঠা (ঝাল), নকশি পিঠা (মিষ্টি), পাকান পিঠা, তেলে ভাজা পিঠা, পায়েস পিঠা, সেমাই কুলি পিঠা, শামুক পিঠা, গোলাপ ফুল পিঠা, লবঙ্গ পিঠা, পাকড়া পিঠা, ডিমের ঝাল পিঠা, মালাই পিঠা ইত্যাদি ছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হরেক নামের বাহারি সব পিঠা দেখা যায়।
মিষ্টি মন্ডার চাইতে সম্ভবত প্রাচীন বাংলায় মিষ্টান্ন হিসেবে পিঠার জনপ্রিয়তা ছিল বেশি। চৈতন্যচরিতামৃতে দেখা যায়, ‘পঞ্চাশ ব্যাঞ্জনে’র সাথে তৈরি হচ্ছে ‘ক্ষীর পুলি নারিকেল পুলি আর পিষ্ট’। বাঙালি এক আধখানা পিঠা খায় না, খায় থালা ভরে। মিষ্টান্ন তো আর একা খাবার জিনিস নয় তাই বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ে দেখা যায়, বছরের প্রথম দিনে বানানো প্রথম পিঠা ঘরের চালের উপর দিয়ে ছুঁড়ে দেওয়া হয় যাতে ‘শেয়াল-কুকুরে’ তা খেতে পারে। কোনো কোনো অঞ্চলের মুসলিম সম্প্রদায়েও এই প্রথা দেখা যায়।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে নারীরাই বয়ে নিয়ে চলেছে পিঠা তৈরির পরম্পরাগত বিদ্যা। রন্ধনশিল্পে বিভিন্ন অংশে পুরষের প্রবেশাধিকার থাকলেও পিঠা তৈরির ক্ষেত্রটি তাই নারীদের অধিকারেই থেকে গেছে সুদীর্ঘকাল ধরে।